উঠান বৈঠকে ব্যস্ত পঞ্চগড়ের প্রার্থীরা
পঞ্চগড় পৌরসভায় শুরু হয়েছে ভোটের প্রচারণা। সম্ভাব্য মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিয়মিত উঠান বৈঠক করছেন। দলীয় প্রতীকে ভোট নিয়ে বিএনপিতে খুব একটা তোড়জোড় নেই। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র গণসংযোগ শুরু করেছেন।
তবে মেয়র পদে সরকার দলীয় মনোনয়ন পেতে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন একাধিক প্রার্থী। জেলার অন্য দুই পৌরসভায় সীমানা নির্ধারণ এবং ওয়ার্ড বিভক্তিকরণ জটিলতায় চলতি নির্বাচন হবে না বলে জানা গেছে।
১৯৮৫ সালের ১৫ জুন পঞ্চগড় জেলা শহরের প্রায় ২২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে জন্ম হয় পঞ্চগড় পৌরসভার। এরপর ৯৪ সালে ২য় শ্রেণি এবং ২০০৫ সালে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পায় এই পৌরসভা। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান মেয়র ও পৌর বিএনপির সভাপতি তৌহিদুল ইসলামের দখলে পঞ্চগড় পৌরসভা। মাঝে একবার জাকের পার্টির নাজিম উদ্দীন আহম্মদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। শান্তিপ্রিয় এবং রাজনৈতিক সৌহার্দপপূর্ণ পঞ্চগড় জেলা শহরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কিছুটা দলীয় অসন্তোষ রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক কোনো সংঘাত নেই বললেও চলে।
আসন্ন পৌর নির্বাচনে দলীয় কোন্দল খুব একটা প্রভাব ফেলবে না বলে দাবি করেছেন বড় দুই রাজনৈতিক সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। তবে চলমান নির্বাচনী হাওয়ায় বেশ সজাগ আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিনের বেদখল পৌরসভার মেয়র পদটি নির্বাচনের মাধ্যমে এবার তারা দখলে নিতে চান। দলীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই মেয়র ও কাউন্সিলর পদে দোয়া চেয়ে রং বেরংয়ের পোস্টার সাটিয়েছেন শহরে। নৌকায় চেপে পৌরপতি হতে চান এসব আওয়ামী লীগ নেতা।
দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ার খবরে বেশ খুশি তারা। নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের একজন করে প্রার্থীর নাম শোনা গেলেও আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য ছয়জন প্রার্থী মেয়র পদে প্রচারণা করছেন। তাদের মধ্যে জেলা আওয়ামী ওলামালীগের উপদেষ্টা ও জেলা মটর মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ আপেল মাহমুদ, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান কাউন্সিলর মো. সফিকুল ইসলাম, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা হুয়ায়ূন কবীর উজ্জল, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিয়া আনোয়ার, আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা সারোয়ার হোসেন এবং আরিফুল ইসলাম পল্লব মেয়র পদে সরকার দলীয় মনোনয়ন পেতে চেষ্টা করছেন।
এদিকে চার বারের নির্বাচিত বর্তমান মেয়র ও পৌর বিএনপির সভাপতি মো. তৌহিদুল ইসলাম এবারও মেয়র পদে শক্ত প্রার্থী। তিনি পৌরসভা জন্মের পূর্বে তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৮৫ সালে পৌরসভা ঘোষণার পর তিনি প্রথম পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে তিনি বিএনপির একক প্রার্থী বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে তিনি ব্যাপকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। প্রতিদিন বাসায় পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডভিত্তিক ভোটারদের নিয়ে পৃথকভাবে বৈঠক করছেন। বেশ আগে ভাগেই সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী হিসেবে নিয়মিত গণসংযোগ শুরু করেছেন তিনি।
অন্যদিকে, সাবেক সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা জামায়াতের আমীর আব্দুল খালেক নির্বাচনে মেয়র পদে অংশ নিতে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করেছেন। জামায়াতের একক প্রার্থী হিসেবে তিনি নিবন্ধন জটিলতায় দলীয়ভাবে অংশ নিতে না পারলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে দাবি করেছেন।
এছাড়া দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে জেলা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সভাপতি আব্দুল মজিদ বাবুলসহ জাতীয় পার্টি এবং জাকের পার্টি থেকে আলাদা মেয়র পদে প্রার্থী থাকবে বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে বড় দুই দলের একাধিক প্রার্থী প্রচারণা শুরু করেছেন। দলীয় আশির্বাদ পেতে তারাও চেষ্টা তদবির অব্যাহত রেখেছেন।
জেলা জাসদ সভাপতি আব্দুল মজিদ বাবুল বলেন, এবারই প্রথম দলীয়ভাবে ও প্রতীকে পৌর নির্বাচন হতে যাচ্ছে। মেয়র প্রার্থী হিসেবে আমার প্রস্তুতি রয়েছে। কেন্দ্রের দিকনির্দেশনা পেলে স্থানীয়ভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।
জেলা জামায়াতের আমির ও সাবেক সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক জাগো নিউজকে বলেন, দলীয়ভাবে প্রার্থী হতে না পারলেও স্বতন্ত্রপ্রার্থী হয়ে পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে অংশ নেব। এজন্য প্রচারণা অব্যাহত রেখেছি।
পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং পৌরসভার প্যানেল মেয়র মো. সফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, চারবার ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি। বর্তমান প্যানেল মেয়র৬ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা আছে। আমিও প্রচারণা চালাচ্ছি। দল আমাকে মেয়র পদে মনোনীত করলে নির্বাচন করবো।
পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম হুয়ায়ূন কবীর উজ্জল জাগো নিউজকে বলেন, মেয়র প্রার্থী হিসেবে দোয়া চেয়ে আমি প্রচারণা চালাচ্ছি। বর্তমান মেয়রকে পরাজিত করতে হলে আওয়ামী লীগ থেকে শক্তিশালী প্রার্থী দিতে হবে। পৌর আওয়ামী লীগ ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতারা যদি মনে করেন তাহলে আমি প্রার্থী হবো।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মির্জা সারোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, পৌর নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হতে চাই। এজন্য প্রচারণা অব্যাহত রেখেছি। দল মনোনয়ন দিলেই আমি প্রার্থী হবো।
জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিয়া আনোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, মেয়র প্রার্থী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে প্রচারণা চালিয়ে আসছি। শহরে ব্যানার ফেস্টুন দিয়ে পৌরবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছি। পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে অসংখ্য উঠান বৈঠক করেছি। বিশেষ করে নারীরা আমাকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দিয়েছেন। বিজ্ঞ মানুষ হিসেবে আশা করি জেলা আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করবেন না।
জেলা আওয়ামী ওলামালীগের উপদেষ্টা ও জেলা মটর মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ আপেল মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, যোগ্য প্রার্থীর অভাবে এখানে বারবার বিএনপির প্রার্থী চেয়ারম্যান ও মেয়র নির্বাচিত হয়ে আসছে। তাকে পরাজিত করতে হলে আওয়ামী লীগের অবশ্যই যোগ্য প্রার্থী মনোনীত করতে হবে। আমি জেলা মটর মালিক সমিতির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। পৌরসভায় মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে দীর্ঘদিন থেকে এলাকায় উঠান বৈঠক করে আসছি। নৌকা মার্কা পেলে আওয়ামী লীগকে পঞ্চগড় পৌরসভা উপহার দিতে পারবো বলে আমি আশা করি।
পৌর বিএনপির সভাপতি ও পঞ্চগড় পৌরসভার বর্তমান মেয়র (জেলা কমিটি নেই) মো. তৌহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ১৯৮৫ সালে পৌরসভা জন্মের পর থেকেই আমি পৌরসভায় প্রতিনিধিত্ব করছি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটাররা প্রতীক নয়, ব্যাক্তি দেখেই ভোট দেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে যার সম্পর্ক বেশি এবং যার দ্বারা এলাকার উন্নয়ন হবে, ভোটাররা তাকেই মেয়র পদে নির্বাচিত করবেন।
তিনি বলেন, যেকোনো প্রতীকেই আমি নির্বাচন করতে প্রস্তুত। মেয়র পদে চারবার নির্বাচিত হয়েছি। তৃতীয় শ্রেণির পৌরসভাকে ক্রমান্বয়ে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেছি। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে আমিই বিএনপির একক প্রার্থী। তবে এসব নির্বাচন দলীয়ভাবে হলে স্থানীয় সরকার কাঠামোগুলো দূর্বল হয়ে পড়বে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট জাগো নিউজকে বলেন, দলের কেন্দ্রীয় দিক নির্দেশনা মেনে স্থানীয়ভাবে ঐক্যমতের ভিত্তিতে পৌর মেয়র পদে প্রার্থী মনোনীত করা হবে। যার ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা আছে, যার পক্ষে ভোট চেয়ে তাকে মেয়র পদে নির্বাচিত করা যাবে, দলীয়ভাবে তাকেই মনোনীত করা হবে। এখানে তদবির বা অন্য কোনো উপায়ে সরকার দলীয় প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। মেয়র পদে সরকার দলীয় মনোনয়ন পেতে যারা কাজ শুরু করেছেন দলের যেকোনো সিদ্ধান্ত মেনে নিতে তারা সকলেই প্রতিশ্রুতিবব্ধ। এ কারণে পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে দলীয় কোন্দলের কোনো আশঙ্কা নেই। দলের সিদ্ধান্ত সকলেই মেনে নেবেন।
এদিকে, জেলার অন্য দুই পৌরসভা বোদা ও দেবীগঞ্জ পৌরসভায় প্রথম পর্যায়ে নির্বাচন হবে না বলে জানা গেছে। ২০০১ সালের ৭ মে বোদা সদর ও চন্দনবাড়ি ইউনিয়নের অংশবিশেষ এবং আটোয়ারী উপজেলার বলরামপুর ইউনিয়নের সাতখামার ও কুড়ুলিয়া মৌজা নিয়ে বোদা পৌরসভা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সীমানা নির্ধারণ ও ওয়ার্ড বিভক্তিকরণ নিয়ে মামলার কারণে তফশিল ঘোষণা করেও নির্বাচন স্থগিত করা হয়। দীর্ঘ ১৪ বছরেও এই পৌরসভায় নির্বাচন হয়নি।
অন্যদিকে, গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর দেবীগঞ্জ উপজেলা শহরকে পৌরসভা ঘোষণা করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এই পৌরসভায় প্রশাসক হিসেবে কাজ করছেন। সেখানে এখন পর্যন্ত সীমানা নির্ধারণ ও ওয়ার্ড বিভক্তিকরণের কাজ শুরু হয়নি। ফলে এ যাত্রায় দেবীগঞ্জ পৌরসভাতেও নির্বাচন হবে না।
এমজেড/এমএস