সুনামগঞ্জে পুরুষশূন্য তিন গ্রাম
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সুনই নদী জলমহালে দুপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার আতঙ্কে পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে বেখইজুড়া, সুনই ও কুষ্টিবাড়ি গ্রাম। গ্রামগুলোর বাড়িতে নেই কোনো পুরুষ মানুষ। ফলে শিশুদের নিয়ে বাড়িতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন নারীরা।
এদিকে, সংঘর্ষে নিহত শ্যামাচরণ বর্মণের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠিয়েছে ধর্মপাশা থানা পুলিশ।
শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলা ১৪২২ সাল থেকে চলতি ১৪২৭ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ২৪ লাখ ২৪ হাজার ৬৬১ টাকা ইজারায় জলমহালটিকে সুনই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির কাছে ইজারা দেয় সরকার। ওই সমিতির পক্ষে চলতি বাংলা বছরের ইজারা মূল্যসহ অন্যান্য সরকারি কর যথারীতি পরিশোধ করা হয়েছে।
কিন্তু স্থানীয় জলমহালের মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে সমিতির দুই প্রভাবশালী সদস্য চন্দন বর্মণ ও সুবল বর্মণের লোকজনের মধ্যে সম্প্রতি বিরোধ দেখা দেয়। এরপর থেকে জলমহালের দখল রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। এ ঘটনার আগেও জলমহালের দখল নিতে পাল্টাপাল্টি মহড়া দেয় উভয়পক্ষের সদস্যরা।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দুপক্ষের সংঘর্ষে চন্দন বর্মণের বাবা শ্যামাচরণ বর্মণকে (৬৫) গলাকেটে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।
এ বিষয়ে স্থানীয় পাইকুরাটি ইউনিয়নের নওয়াদার গ্রামের বাসিন্দা তানুয়ার মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘জলমহাল নিয়ে সমিতির সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে আসছে। তাদের জন্য সাধারণ মানুষের শান্তি নষ্ট হচ্ছে।’
গ্রামের বাসিন্দা আতিক মিয়া বলেন, ‘জলমহালের সংঘর্ষের ঘটনায় এখন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের জড়ানো হচ্ছে। অথচ উভয়পক্ষের সদস্যরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে রাতের আঁধারে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। নির্মমভাবে শ্যামাচরণ বর্মণকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। ওই ঘটনার পর থেকে তিনটি গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে।’
হিলা রানী নামে এক গৃহবধূ বলেন, ‘আমার স্বামী গতরাত থেকে গ্রেফতারের ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। তিনি বাড়িতে না থাকায় খুব ভয় লাগছে।’
বিবাদমান একটি পক্ষের নেতা চন্দন বর্মণ জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যানের মদদে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।’
সুষ্ঠু তদন্ত করে এ ঘটনার বিচার দাবি করেন তিনি।
তার প্রতিপক্ষ সুবল বর্মণ বলেন, ‘ঘটনার আগের দিন থেকে উপজেলার পার্শ্ববর্তী নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী জলমহাল সংলগ্ন এলাকায় মহড়া দেয়। সন্ত্রাসী সুষেন, রব্বানী, মিষ্টু কাঈয়ুমকে জলমহাল এলাকায় ঘুরাঘুরি করতে দেখা গেছে। তাদের নামে মোহনগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা সহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। বিগত ১৫ দিন আগেও তারা জলমহাল এলাকায় অস্ত্রসহ মোটরসাইকেলে মহড়া দিয়েছেন।তারাই খুন ও হামলার ঘটনা ঘটিয়ে ফায়দা লুটতে চায়। নিরপেক্ষ তদন্ত করলে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে।’
বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়েছিল বলেও দাবি করেন সুবল।
এদিকে, ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে ধর্মপাশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন রুকন বলেন, ‘অফিসিয়াল কাজে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমি সুনামগঞ্জ জেলা সদরে ছিলাম। নবাগত জেলা প্রশাসকের সঙ্গে মতবিনিময় সভা ও সদরের মেয়র প্রার্থীর পক্ষে গণসংযোগ করেছি। রাতে এ ঘটনার খবর জানতে পারি। এতে আমার বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা নেই। ফায়দা লুটতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আমার নামে অপপ্রচার করছে। আমিও এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার দাবি করি।’
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘গ্রামবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। অহেতুক কাউকে গ্রেফতার বা হয়রানি করা হবে না। এ ঘটনায় রাতেই ২৩ জনকে আটক করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে রয়েছেন।’
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রাতে সুনই নদী জলমহালের দখল নিয়ে সমিতির বিবাদমান সদস্য সুবল বর্মণ ও চন্দন বর্মণের লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ ঘটনায় খুন হন শ্যামাচরণ বর্মণ। আহত হন ১৫ জন। রাতেই পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ২৩ জনকে আটক করে।
হতাহত কিংবা সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করেনি কোনো পক্ষ।
লিপসন আহমেদ/এসএস/জেআইএম