ভাটার থাবায় মরছে নদী

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক খুলনা
প্রকাশিত: ০৯:৪৫ এএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০

অডিও শুনুন

খুলনায় ইটভাটা স্থাপনের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম নীতি, পরিবেশ আইন বা ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন যে কোনো কাজে আসছে না তা বোঝা যায় ভদ্রা নদী দখল করে গড়ে ওঠা ইটভাটা দেখলে। ইটভাটার মালিক ভাটার জমি বাড়াতে গিয়ে ভদ্রা নদী গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছেন।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা, হরি ও ঘ্যাংরাইল নদী, রূপসার আঠারোবাকি নদী, বটিয়াঘাটার কাজিবাছা নদী, পাইকগাছার শিবসা নদী, কয়রার কপোতাক্ষ নদসহ বিভিন্ন নদীর পাড়ে ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ভাটা মালিকরা প্রতি বছর নদীর বুক দখল করে ভাটার বিস্তৃতি বাড়াচ্ছেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কেবি ব্রিকস নামের একটি ইটভাটা ভদ্রা নদীর সীমানা নির্ধারণকারী পিলার থেকে আরও ভেতরে ইট-সুরকি ও বালু দিয়ে নদী ভরাট করে দখলে নিয়েছে। ভাটায় শুধু কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানোর নিয়ম থাকলেও এখানে গাছের গুঁড়ি ও কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় মালিকদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহসও পায় না।

কেবি ব্রিকসের মতো ভদ্রা ও হরি নদীর চার কিলোমিটারের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় ১৮টি ইটভাটা। ইটভাটার মালিকেরা জায়গা দখল করায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। কোথাও কোথাও নদী প্রায় মরে গেছে। এতে ভাঙনের হুমকির মুখে পড়েছে সেতু ও বাজার।

ভাটাগুলোর অধিকাংশ বসতবাড়ির ১০ থেকে একশ গজের মধ্যে। বসতবাড়ির কাছে হওয়ায় ভাটার ধোঁয়া-বালুতে অতিষ্ট বাসিন্দারা।

ডুমুরিয়ার খর্ণিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ইটভাটার চারপাশে মাটি ফেলে ভদ্রা নদীর চর ভরাট করে পুরো জমি উঁচু করা হয়েছে। খননযন্ত্র (এস্কেভেটর) দিয়ে বড় বড় গর্ত করে মাটি তুলে ইট তৈরি করা হচ্ছে। আর কাঠ পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। ভাটার পাশে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য কয়েকশ মণ কাঠ স্তূপ করে রাখা।

জানতে চাইলে কেবি ব্রিকসের মালিক ও সদর ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বুলু বলেন, বেশির ভাগ জমিই স্থানীয় মালিকদের কাছ থেকে নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে একটি চুক্তি করে নেয়া হয়েছে। আর কিছু জমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের। সেখানে আমরা শুধুমাত্র মাটি কেটে ফেলে রাখি।

পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনের কোনো অনুমোদন আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সবকিছুর অনুমোদন নিয়ে ইটভাটা পরিচালনা করছি।

কৃষিজমিতে কীভাবে অনুমোদন পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০ বছর আগে থেকে এই ভাটার কার্যক্রম চলে আসছে। তখন কৃষিজমি বোঝার উপায় ছিল না। এখন যারা ভাটা নির্মাণ করছে তারাই নদী ও কৃষি জমি ব্যবহার করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

khulna-Brick-Field-(2).jpg

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ২০১৩ অনুচ্ছেদ ৮-এর (গ) ধারা অনুযায়ী, সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, কৃষিজমি, বাগান ও জলাভূমি এলাকায় ইটভাটা স্থাপন দণ্ডনীয় অপরাধ।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খুলনা জেলায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইটভাটার সংখ্যা ১৫৩টি। ভাটার রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রতি বছর নবায়ণ করা লাগলেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে অধিকাংশ ইটভাটা নবায়ণ না করে কার্যক্রম চালিয়ে যায়।

খর্ণিয়া গ্রামের ইকবাল হোসেন বলেন, ভাটাগুলো প্রতিনিয়ত নদী মেরে ফেলছে। ইটভাটার শ্রমিকরা রাতে বস্তার মধ্যে ইটের টুকরো ভরে ভাটার সামনে নদীতে ফেলছে। এতে পানি বাধা পেয়ে পলি জমার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বাঁধ দিয়ে দিচ্ছে। এভাবে নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে।

রানাই গ্রামের মনিরুল ইসলাম বলেন, ভাটার ধোঁয়া আর বালুতে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে। কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করায় ফসলের আবাদ কমে যাচ্ছে। এছাড়া অতিরিক্ত বোঝাই দিয়ে ট্রাক-ট্রলি ইট বহনের কারণে রাস্তাটি দ্রুত নষ্ট হওয়ার পথে।

ডুমুরিয়ার আটলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রতাপ কুমার রায় বলেন, প্রতিবছর ভাটার লাইসেন্স নবায়ণ করতে হলে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। ইউনিয়নে ১১টি ইটভাটা থাকলেও চলতি অর্থবছরে কোনো ভাটার মালিক ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেননি।

জানতে চাইলে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, সরকার বলছে নদী বাঁচলে, বাঁচবে দেশ। আর ভাটা মালিকরা বলছে নদী মরলে আমরা বাঁচব। নদী দখল হলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লাভ বেশি। তারা খননের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করতে পারবে। সে কারণে তারাও কিছুই বলছে না।

তিনি আরও বলেন, নদী ভরাট হলে নদীর পাশে বসবাসকারী ১০ থেকে ১৫ গ্রামের হাজারো মানুষ বছরের আট মাস পানির নিচে ডুবে থাকবে। তাছাড়া ভবদহের পানি নিষ্কাশন নিয়েও জটিলতার সৃষ্টি হবে।

পরিবেশ অধিদফতরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক সাইফুর রহমান খান বলেন, পরিবেশ আইনের আওতায় যদি সঠিক থাকে, তাহলে সেই ইটভাটার অনুমোদন দিয়ে থাকি। তবে নদী দখল করে ভাটা থাকলে তা সম্পূর্ণ অবৈধ।

এ ব্যাপারে খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, যারা নদী দখল করছে বা অবৈধভাবে ভাটা চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আট লাখ টাকা জরিমানা সঙ্গে লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। ইটভাটার বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।

আলমগীর হান্নান/এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।