ঝালকাঠিতে লাল সবুজের পতাকা ওড়ান মুক্তিযোদ্ধারা
আজ ঝালকাঠি মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকহানাদার মুক্ত হয় দক্ষিণের জেলা ঝালকাঠি। একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ঝালকাঠি শহরের চারপাশে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে ঢুকতে শুরু করেন। সন্ধ্যায় ঝালকাঠি থানা অবরুদ্ধ করেন তারা। তৎকালীন পুলিশের সিআই শাহ আলম আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ করেন। ঝালকাঠির তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সেলিম শাহনাজের কাছে ঝালকাঠি থানা পুলিশ অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করলে জেলাটি হানাদার মুক্ত হয়। হানাদারমুক্তির খবর ছড়িয়ে পড়লে আনন্দ-উল্লাস আর জয় বাংলা স্রোগানে সড়কে নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ।
মুক্তিযোদ্ধা পার্থ সারথি দাস জানান, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ঝালকাঠিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢুকে নিরীহ বাঙালিদের ওপর আক্রমণ করে। চালায় বর্বর নির্যাতন, অমানুষিক অত্যাচার, পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা। দিশাহারা করে তোলে ঝালাকঠিবাসীকে। সদর থানার তৎকালীন এসআই শফিকের নেতৃত্বে প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রতিরোধ সংগঠিত হতে শুরু করে। বন্দুকসদৃশ্য অস্ত্র দিয়ে তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ এবং রণকৌশল শিখিয়ে দিতেন। পাকবাহিনীর অত্যাচারের প্রতিরোধ করতে শুরু করে বাঙালিরা। মুক্তিযোদ্ধারা হামলার পর পাল্টা জবাব দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে ঘায়েল করে ভীতসন্ত্রস্ত করতে শুরু করে। আস্তে আস্তে পাকবাহিনী আতঙ্কিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হার মানতে শুরু করে। প্রতিজ্ঞা নেয় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে স্বমূলে বিনাশ করবে। সে অনুযায়ী ১৩ নভেম্বর সদর উপজেলার নথুল্লাবাদ গ্রামের চাচৈরে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার বলেন, ঝালকাঠির সদর উপজেলার চাচৈর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সাব-ক্যাম্প। নলছিটি উপজেলা কমান্ডার মো. সেকান্দার মিয়ার নেতৃত্বে ২৮ জন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার এ ক্যাম্পে পাকহানাদার বাহিনী আক্রমণ করবে বলে ১২ নভেম্বর রাতে খবর পায়। ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরকে জানালে তিনি ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধা, সদর উপজেলা কমান্ডার সুলতান হোসেন মাস্টার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমাদের সঙ্গে ১৩ নভেম্বর সকালে যোগ হয়। ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর আমাদের রণকৌশল জানিয়ে দেন। পাকহানাদার বাহিনী ধীরে ধীরে আমাদের ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালানোর জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নেন মুক্তিযোদ্ধারা।
সকাল ১০টায় এক প্লার্টুন পাকহানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে চাচৈর গ্রামে। মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম তিনদিক থেকে পাকহানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। দক্ষিণদিক খোলা পেয়ে সেদিকে পিছু হটতে থাকে তারা। ইতোমধ্যে অনেক রাজাকার ও পাকহানাদার সদস্য নিহত হয়। একই এলাকার খানবাড়ি চতুর্দিক থেকে ঘিরে থাকায় মাঝখানের আঙিনায় ঢুকে রাজাকার ও হানাদার বাহিনী আশ্রয় নেয়। ইতোমধ্যে তাদের অনেকেই গুলি লেগে আহত হন। সেই পূর্ব কৌশলে দক্ষিণ দিকের ছনবনে মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে হামলা করার প্রস্তুতি নিয়ে বাকি তিনদিক থেকে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে আতঙ্কিত করতে থাকেন।
এদিকে পাকসেনারাও পাল্টাগুলি ছুঁড়লে শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। শহীদ হন কাঠিপাড়ার আব্দুল আউয়াল, খানবাড়ির বাসিন্দা আদু খান, হামেদ আলী, সেকান্দার মাঝি, আলেয়া ও তার ছোট ভাই শহীদ হন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে হানাদার বাহিনী দক্ষিণদিক খোলা দেখে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। সেখানে ওতপেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা সুযোগ বুঝে ব্রাশফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই ১৮ জন পাকহানাদার নিহত হয়। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে যুদ্ধ। এ সম্মুখযুদ্ধে রাজাকার ও পাকহানাদার কমান্ডারসহ প্রায় ৬০ জন নিহত এবং মুক্তিযোদ্ধাসহ ছয়জন শহীদ হন। আলোচিত এই যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয় ঘটে পাকবাহিনীর। বিজয়ী হন মুক্তিযোদ্ধারা।
ঝালকাঠির রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা জানান, জেলার রণাঙ্গন একমাত্র সম্মুখ যুদ্ধস্থান চাচৈরে প্রচণ্ড বেগে যুদ্ধ শুরু হয় ১৩ নভেম্বর। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুক্তিযোদ্ধা আউয়াল এ যুদ্ধে শহীদ হলেও বহু পাকসেনা প্রাণ হারায়। নলছিটি ১৫ নভেম্বর থানা কমান্ডার সেকান্দার আলীর নেতৃত্বে নলছিটি থানা আক্রমণ হয়। সেখানে কয়েকজন হানাদার নিহত হয়। ৭ ডিসেম্বর রাতে জেলা শহরে কারফিউ ঘোষণা করে। এদিন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সেকান্দার আবার থানা আক্রমণ করেন। এতে পাকসেনা, রাজাকার, আলবদরদের পরাজয় ঘটে। তাই সব বাহিনীকে নিরস্ত্র করে মুক্তিযোদ্ধারা তালতলা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরদিন ৮ ডিসেম্বর সকালে যাকে দেখা যাবে তাকেই গুলি করে হত্যা করা হবে বলে- কারফিউ ঘোষণা দিয়ে পাকবাহিনী ঝালকাঠি শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়।
সে সময়কার তরুণ মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আনোয়ার হোসেন পান্না বলেন, বারেক রাজাকার ৩৬ সদস্যের রাজাকার বাহিনী নিয়ে শহরের কাঠপট্টি এলাকায় তার নেতৃত্বে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয়দের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পাকবাহিনী শহর ছেড়ে যাওয়ার পর রাজাকাররা পালাতে শুরু করে। এ সময় তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে রাজাকারদের ঘিরে ফেললে রাজাকাররা রাইফেল ফেলে আত্মসমর্পণ করে। পরে রাজাকারদের শহরের পশ্চিম ঝালকাঠি নিলে গণধোলাইয়ে রাজাকার বারেক নিহত হয়। একই দিন সকালে নলছিটি থানার তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তারা মুক্তিযোদ্ধা সেকান্দার আলী মিয়ার কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। ৭ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা থানা ঘেরাও করে রাখে। নলছিটি থানা পুলিশ প্রাথমিক পর্যায় প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও চারদিক থেকে অবরুদ্ধ অবস্থা দেখে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ফলে ৮ ডিসেম্বর নলছিটি বন্দরও হানাদার মুক্ত হয়।
মো. আতিকুর রহমান/বিএ/জেআইএম