পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন দেখেন মুন্না
বুক থেকে পা পর্যন্ত প্যারালাইজড। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে হুইল চেয়ারের সাহায্যে চলাফেরা করছেন হেদায়তুল আজিজ মুন্না। তবুও থেমে নেই তার জীবন। হুইল চেয়ারে বসেই লড়ছেন, অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন সকল প্রতিবন্ধীদের।
প্রতিবন্ধীত্ব তার কাছে প্রতিবন্ধকতা নয় বরং এগিয়ে চলার শক্তি। অদম্য মুন্না মনে করেন, হুইল চেয়ারে বসেও পৃথিবীটাকে জয় করা যায়। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন প্রতিবন্ধীদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী বদলানো। আর সেজন্যই লড়ে যাচ্ছেন তিনি। শুরুতে একা থাকলেও এখন তার লড়াইয়ের সারথি অনেক সুস্থ-সবল মানুষও।
শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই যুবক নিজের যোগ্যতা প্রমাণের মাধ্যমে সুস্থ-সবলদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন প্রতিবন্ধীরা বোঝা নয় বরং সম্পদ। ২০১৯ সালের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সম্মাননা লাভ করেন মুন্না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হাতে সম্মানা স্মারক তুলে দেন।
মুন্না ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের পশ্চিমপাইকপাড়া এলাকার মো. আজিজুর রহমানের ছেলে। ২০০৮ সালে সৌদি আরবে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন তিনি।
তখনই হয়তো তার জীবন থেমে যেতে পারত। কিন্তু মুন্নার ইচ্ছাশক্তি তাকে নিয়ে গেছে সাফল্যের শিখরে।
মুন্নার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নিয়ে ২০০৩ সালে সৌদি আরব যান তিনি। সেখানে চাকরির পাশাপাশি ব্যবসাও ছিল তার। চাকরি-ব্যবসা মিলিয়ে ভালোই চলছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনায় স্পাইনাল কর্ড ইঞ্জুরির ফলে পঙ্গু হতে হয় তাকে।
দুর্ঘটনার পর ২২ দিন কোমায় ছিলেন মুন্না। পরবর্তীতে পারিবারের সিদ্ধান্তে তাকে দেশে এনে প্রথমে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসার পর সাভারের সিআরপিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
পঙ্গু হওয়ার পর মুন্না তার জীবনে প্রথম উপলব্দি করতে পারেন প্রতিবন্ধী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা কী দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেন! প্রতিবন্ধীদেরকে সমাজে কেমন তাচ্ছিল্যের পাত্র মনে করা হয়। তখন থেকেই নিজে ঘুরে দাঁড়ানোর পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু একটা করার প্রবল ইচ্ছা জাগে মুন্নার মনে।
কিন্তু নিজে প্রতিবন্ধী হয়ে অন্য প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করাটা কষ্টকরই ছিল। কারণ নিজেরই চলাফেরায় অন্যের সাহায্য নিতে হয়। তবুও দমে যাননি তিনি। প্রবল ইচ্ছা আর সাহস নিয়ে গড়ে তোলেন ড্রিম ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিবন্ধীদের যুক্ত করেন অলাভজনক এই সংগঠনে।
২০১৩ সালে যাত্রারাম্ভ করা এই সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসাই ছিল মুন্নার একমাত্র লক্ষ্য। সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর প্রতিবন্ধীদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পাইকপাড়া এলাকায় একটি একীভূত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন মুন্না। ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রতিবন্ধীদের কম্পিউটারসহ নানা কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়।
ক্রীড়া খাতে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য ড্রিম ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশন থেকে একটি হুইল চেয়ার ক্রিকেট দল গঠন করা হয়। ২০১৭ সালে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট সিরিজে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে ভারতের হুইল চেয়ার ক্রিকেট দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও অর্জন করে ওই ক্রিকেট দলটি।
এছাড়া ২০১৯ সালে ভারতের কোলকাতায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় ক্রিকেট সিরিজে ভারত ও নেপালকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে ড্রিম ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশনের হুইল চেয়ার ক্রিকেট দল।
ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ডিডিএফ শারীরিক প্রতিবন্ধী ফুটবল দলও গঠন করেছেন মুন্না।
ড্রিম ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশনের সদস্য ও হুইল চেয়ার ক্রিকেট দলের সহঅধিনায়ক শফিকুল ইসলাম বলেন, স্কুলে পড়ুয়া অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে আমি পঙ্গু হই। দুর্ঘটনার পর মনে হয়েছিল আমার জীবন শেষ। চরম হতাশায় ভুগছিলাম। কেউ স্বাভাবিক আচরণ করত না আমার সঙ্গে। কিন্তু আমি একটা সময় উপলব্দি করলাম জীবনটা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি, কিছু করার সুযোগ এখনও রয়েছে। এরপর থেকে আমি নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
‘ইতোমধ্যে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছি। যখন মুন্নাকে দেখি হুইলচেয়ারে বসেও প্রতিবন্ধীদের জন্য লড়ছে, তখন অনেক অনুপ্রেরণা পাই। আমরা ড্রিম ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের স্বনির্ভর করে গড়ে তুলে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজটাই করে যাচ্ছি’ বলেন শফিকুল ইসলাম।
ড্রিম ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা হেদায়তুল আজিজ মুন্না বলেন, যে পরিবারে একজন প্রতিবন্ধী থাকে সেই পরিবারটির কষ্ট কেউ বোঝে না। মানুষের অবজ্ঞা-অবহেলা ওই পরিবারটির দুঃখ-যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দেয়। সেজন্য প্রতিবন্ধীদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক উদাহারণ আমি দেখেছি। হুইল চেয়ারে বসেও পৃথিবী জয় করা যায়।
‘প্রতিবন্ধীত্ব আমার কাছে এগিয়ে চলার শক্তি। প্রতিবন্ধীরাও যে সুযোগ পেলে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনতে পারে সেটি ইতোমধ্যে প্রতিবন্ধীরা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মান অর্জনের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে। আমরাও সবার সঙ্গে মিলে দেশকে এগিয়ে নিতে চাই’ যোগ করেন মুন্না।
প্রতিবন্ধীদের জন্য মুন্না যে লড়াইটা শুরু করেছিলেন, সেই লড়াইয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি থেকে শুরু করে রাজনীতিকরাও যুক্ত হয়েছেন। যখন প্রতিবন্ধীদের দিকে আর কেউ বাঁকা চোখে তাকাবে না, প্রতিবন্ধী বলে অবজ্ঞা করবে না তখনই শেষ হবে মুন্নাদের অধিকার আদায়ের লড়াই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি লোকমান হোসেন বলেন, মুন্না নিজে প্রতিবন্ধী হয়েও প্রতিবন্ধীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তার এই কাজে আমি নিজেও ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হই। আমরা যেহেতু সুস্থ-সবল আছি, আমাদেরও কিছু দায়বদ্ধতা আছে। আমাদের সবার উচিত প্রতিবন্ধীদের বাঁকা চোখে না দেখে, তাদেরকে নিজেদের মতো ভাবা এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করা।
এফএ/পিআর