ভাড়ায় চলে মেডিকেল কলেজ, দেখে ফেলায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক রাজশাহী
প্রকাশিত: ০৮:৫৭ এএম, ২৯ নভেম্বর ২০২০

স্থায়ী শিক্ষক নেই। ভাড়াটে শিক্ষক দিয়ে নামেমাত্র পাঠদান চলছিল রাজশাহীর শাহমখদুম মেডিকেল কলেজে। ল্যাবে নেই শিক্ষা সরঞ্জামাদি। প্রতারণার জালে আষ্টেপৃষ্ঠে শিক্ষাজীবন ধ্বংসের পথে সাত ব্যাচের ২২৫ জন শিক্ষার্থীর।

২০১৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শর্ত সাপেক্ষে পাঠদানের আনুমোদন পায় শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ। এরপর থেকেই শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির বাণিজ্য। কলেজে প্রথম ব্যাচে ১৮ জন ও দ্বিতীয় ব্যাচে ২৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন।

তৃতীয় ব্যাচে কলেজ কর্তৃপক্ষ আসন সংখ্যা বৃদ্ধির আবেদন জানায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিদর্শন শেষে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ২৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করার অনুমোদন দেয়। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি নেয়।

এ ঘটনায় ২০১৬ সালে ওই বর্ষের কার্যক্রম স্থগিত করে কলেজ কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। জবাবে সন্তুষ্ট না হওয়ায় ওই শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রম স্থগিতই রাখা হয়। প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ পরিচালনার কোনো শর্ত পূরণ না হওয়ায় গত ২ নভেম্বর কলেজটি বন্ধের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

একইসঙ্গে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের দেশের যেকোনো প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে দ্রুত মাইগ্রেশনের ব্যবস্থা করতে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়।

এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানাচ্ছে, শাহমখদুম মেডিকেল কলেজ পরিচালনা ও শিক্ষার্থী ভর্তির উপযোগী নয়। সেইসঙ্গে চলতি শিক্ষাবর্ষে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি না করারও নির্দেশ দেয়া হয়। শর্তহীনভাবে শিক্ষার্থীদের ছাড়পত্র দিতেও কলেজ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

কিন্তু সেই নির্দেশনা না মেনে উল্টো এই নির্দেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এর প্রেক্ষিতে শনিবার মন্ত্রণালয়ের চার সদস্যের একটি টিম কলেজটি পরিদর্শনে আসেন।

তার আগেই তড়িঘড়ি করে শুক্রবার বিকেলে কলেজের ল্যাবে ভাড়া করা সরঞ্জাম তুলছিল কর্তৃপক্ষ। ক্যাম্পাসে গিয়ে বিষয়টি দেখে ছবি তোলায় বেদম পেটানো হয় শিক্ষার্থীদের। এতে অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আহত হন।

এ ঘটনায় রাতেই হামলার শিকার কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বাদী হয়ে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ১২ থেকে ১৩ জনকে আসামি করে নগরীর চন্দ্রিমা থানায় মামলা করেছেন।

m-collage1

ওই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মনিরুজ্জামান স্বাধীনকে। ওই মামলায় রাতেই এমডির স্ত্রী মোছা. বিউটি ও এমডির ভাই মাহাদী হাসান মিঠুকে (৩০) গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শিক্ষার্থীরা শনিবার সকাল থেকে কলেজের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন। ওই সময় কলেজ পরিদর্শনে যান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। তারা শিক্ষার্থীদের অভিযোগ শোনেন ও ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, মন্ত্রণালয়ের একটি টিম মেডিকেল কলেজটি পরিদর্শন করবে এবং তাদেরকে দেখানোর জন্য শুক্রবার সন্ধ্যায় অন্য জায়গা থেকে মেডিকেল সরঞ্জাম এনে শাহমখদুম মেডিকেল কলেজের ল্যাবে নেয়া হচ্ছিল। শিক্ষার্থীরা তা দেখে ছবি তুলছিলেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।

শিক্ষার্থীরা আরও অভিযোগ করেন, কলেজের ওয়েবসাইটে ৪০ জন শিক্ষকসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে সব কিছু ঠিকঠাক চলছে এমন সব তথ্য তুলে প্রচার করে প্রতিটি সেশনে শিক্ষার্থী আকর্ষণ ও ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ভাড়া করা শিক্ষক ও ভাড়ায় আনা মেডিকেল সরঞ্জাম দেখিয়ে একাডেমিক অনুমতি নবায়ন করে আসছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।

এখানে চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষার কোনো পরিবেশ নেই। যখন উপর মহল থেকে কেউ পরিদর্শনে যান তখন নগরীর বিভিন্ন ক্লিনিক ও ল্যাব থেকে যন্ত্রপাতি ও গবেষণা সরঞ্জাম ভাড়ায় নিয়ে ল্যাবে সাজিয়ে রাখা হয়। পরিদর্শন শেষ হলে সেসব সরঞ্জাম ফেরত দেয়া হয়। পরিদর্শনের সময়ও শিক্ষক ভাড়া করে আনা হয়।

আর শিক্ষার্থীরা ভর্তি ও সেশন ফি বাবদ যে টাকা পরিশোধ করে থাকেন সেগুলি দিয়ে শুধু জমি কেনার কাজ চলে। আর এসব টাকা দিয়ে কিছু ভবন তৈরির কাজ হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বলতে সেখানে কিছু হয় না। এরআগেও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের দাবিতে শিক্ষার্থী একাধিকবার আন্দোলন করেছেন।

এ বিষয়ে শাহমখদুম মেডিকেল কলেজের এমডি মুনীরুজ্জামান স্বাধীন বলেন, মন্ত্রণালয়ের টিম পরিদর্শনে কলেজে আসছেন এই খবর পেয়ে কতিপয় শিক্ষার্থী শুক্রবার সন্ধ্যায় কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। কর্মকর্তা কর্মচারিরা তাদের বাধা প্রদান করেন। শিক্ষার্থীরা কর্মকর্তা কর্মচারিদের ওপর হামলা করেন।

এদিকে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) প্রতিনিধি হয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই দলে ছিলেন প্রফেসর ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মেডিকেল কলেজের যে পরিবেশ থাকা উচিত সেটি না থাকলে মেডিকেল কলেজ চলবে না। আর যদি তারা পরিবেশ তৈরি করতে পারে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারে, তাহলে এই মেডিকেল কলেজের ব্যাপারে কী করা যায় আমরা ঢাকায় বসে সিদ্ধান্ত নেব।

এ সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানান প্রফেসর ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ। তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার কথাও জানান তিনি।

তিনি বলেন, যদি কখনও কলেজ চালু করতে হয় তাহলে শিক্ষক আনতে হবে। শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীদের মাইগ্রেশনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।