করোনায় কপাল পুড়েছে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের

জিতু কবীর
জিতু কবীর জিতু কবীর , নিজস্ব প্রতিবেদক রংপুর
প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ২০ নভেম্বর ২০২০
নারী উদ্যোক্তা শামসুন নাহার

অডিও শুনুন

মরণঘাতি করোনা ভাইরাসের থাবায় মুখ থুবড়ে পড়েছে রংপুর অঞ্চলের কয়েকশ নারী উদ্যোক্তার স্বপ্ন। ব্যবসায় চলছে মন্দা। নেই ব্যাংক ঋণ সুবিধা ও আর্থিক প্রণোদনা।

অনেকেই বন্ধ করে দিয়েছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কারখানা। দু’একজন টিকে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত এ লড়াইয়ে কতটা সফল হবেন তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।

ব্যাংক ঋণে জটিলতা, আর্থিক প্রণোদনা না পাওয়া, তৈরিকৃত পণ্য বিক্রি না হওয়াসহ নানা কারণে ভালো নেই এসব ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা।

রংপুর নগরীর দর্শনা কলেজপাড়া এলাকার ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা লাইজুতুন জান্নাত। তিনি পাট থেকে পণ্য তৈরি করে বিক্রি করতেন। একটা সময় ২০০ জন শ্রমিক তার অধীনে কাজ করলেও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে তা কমতে কমতে বর্তমানে ৩০/৪০ জনে এসে দাঁড়িয়েছে।

তৈরিকৃত মালামাল বিক্রি না হওয়ায় ঠিকমতো মজুরি দিতে পারছিলেন না তিনি শ্রমিকদের। ফলে ধীরে ধীরে কমতে থাকে উৎপাদন, কমতে থাকে শ্রমিক ও আয়। এক পর্যায়ে পুঁজি হারিয়ে এখন কোনোমতে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন লাইজুতুন জান্নাত। সরকারিভাবে আর্থিক প্রণোদনার কথা বলা হলেও তা জোটেনি তার কপালে।

লাইজুতুন জান্নাত বলেন, টাকার অভাবে সিজনের সময়ও কম দামে পাট কিনতে পারছি না। বড় মহাজনরা পাট কিনে স্টক করছেন। একটা সময় পাটের দাম বৃদ্ধি পেলে তখন আরও কেনা সম্ভব হবে না। সরকারিভাবে যে প্রণোদনার কথা বলে হয়েছিল তাও পাইনি। বাধ্য হয়ে এ পেশা গুটিয়ে নিতে হচ্ছে।

লাইজুতুন জান্নাতের মতো আরেক উদ্যোক্তা নাছিমা আক্তার। নিজ গ্রাম রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার রানীবন্দরে পাটপণ্যের হস্তশিল্প কারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি রংপুর নগরীতে বাসা ভাড়া নিয়ে বীকন মোড়ে দিয়েছিলেন শো-রুম।

করোনা ভাইরাস শুরুর আগে প্রায় দেড় লাখ টাকার কাঁচামাল কিনেছিলেন। পণ্য তৈরি না করতেই শুরু হয় লকডাউন। ফলে কাঁচামাল কেনাতেই আটকে থাকে সবটুকু পুঁজি।

কয়েক মাস পর জমানো সবটুকু শেষ হলে বন্ধ করে দেন শো-রুম। বাসা ভাড়া দিতে না পারায় ফিরে যান গ্রামে। বন্ধ করতে বাধ্য হন কারখানাও। বর্তমানে গ্রামের আশপাশের নারীদের বাড়িতে কাজের অর্ডার দিয়ে কোনোরকমে ধরে আছেন এ পেশা।

নাছিমা আক্তার জানান, প্রণোদনার টাকা পেতে ব্যাংকে গিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তা জোটেনি। বিভিন্ন জটিলতার কথা বলে ব্যাংক থেকে তাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। মোট ঋণের ১০ শতাংশ দিতে চাইলেও বিভিন্ন জটিলতার কারণে তিনি নিরাশ হয়ে ফিরে আসেন।

নগরীর মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইন্স এলাকার বাসিন্দা শামসুন নাহার। চীন-ভারত থেকে আমদানি নির্ভর না হয়ে দেশেই পণ্য তৈরি করে নিজেকে ও দেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখেন এই ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা।

‘নকশিপল্লী’ নামে কারখানা খুলে যাত্রাও শুরু করেছিলেন তিনি।

কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেনি কেউ। আর্থিক প্রণোদনা তো দূরের কথা ঋণ দিতেও ভরসা পায়নি কোনো ব্যাংক। করোনাকালীন কারখানা বন্ধ থাকার পর নতুন করে আবার কাজ শুরু করেছেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত কতদূর যেতে পারবেন তা নিয়ে শঙ্কার কথা বলছিলেন শামসুন নাহার।

লাইজুতুন জান্নাত, নাছিমা ও শামসুন নাহারের মতো এমন কয়েকশ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা এখন পুঁজি হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব। আবার ঘুরে দাঁড়ানোর মতো নেই সামর্থ্য। পারছেন না সরকারি-বেসরকারি বড় কোনো আর্থিক সহযোগিতাও।

‘দি এশিয়া ফাউন্ডেশন’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার তালিকাভুক্ত রংপুর বিভাগের ২৮০ জন ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার কেউই পায়নি সরকারের আর্থিক প্রণোদনা।

সংস্থাটির তথ্য মতে, তালিকাভুক্ত এই ২৮০ জন নারী উদ্যোক্তার কেউই ভালো নেই। অনেকের পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল কেনার সামর্থ্য নেই। আবার কাঁচামাল কিনে সীমিত পরিসরে উৎপাদন করলেও তা বাজারজাত করা নিয়ে পড়ছেন বিপাকে। তালিকার বাইরেও এমন কয়েক হাজার ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা আর্থিক সংকটে পড়েছেন।

এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে হতাশ হয়ে পড়বেন ক্ষুদ্র নারী উদ্যেক্তারা এমনটাই মনে করছেন সংস্থাটির ফিল্ড টিম লিডার সরদার আকরামুজ্জামান।

তিনি বলেন, সরকার কর্তৃক লকডাউন শিথিল করা হলেও মহামারির প্রভাব এখনও সর্বত্র বিস্তৃত। কোডিড-১৯ কালীন সময়ের গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরুষদের তুলনায় গুরুতর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। যেমন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সীমান্ত বন্ধ থাকা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি। এই সংকট নারীদের ওপর বিশেষভাবে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।

তিনি আরও বলেন, সরকার কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগের পরও নারী উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশের এই মহামারির পরবর্তী অবস্থা মোকাবিলা করার সক্ষমতা খুবই সীমিত। উপরন্তু এমএসএমই খাতের একটি বড় অংশ নারী উদ্যোক্তাদের দ্বারা পরিচালিত হয়, যারা পুরুষ উদ্যোক্তাদের তুলনায় আর্থিক সম্পদের দিক থেকে পশ্চাৎপদ এবং সরকার কর্তৃক প্রদত্ত আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ পাওয়ার হারেও সীমিত।

এতমাবস্থায় নারীদের নেতৃত্বাধীন এমএসএমইর টিকে থাকা এবং নতুন করে ব্যবসা শুরু করা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে ধারণা করছেন তিনি।

এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।