গৃহবধূকে মৃত্যুর কাছ থেকে ছিনিয়ে আনলেন কনস্টেবল রানু
অডিও শুনুন
অল্প বয়সেই বিয়ে হয় তন্নীর (৩০)। সংসারে দুটি সন্তানও রয়েছে। তবে স্বামী তন্ময় মাদকাসক্ত হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে হচ্ছে বছরের পর বছর। জীবনের প্রতি তার এখন চরম বিরক্তি। স্বজনদের প্রতি তার অনেক অভিমান।
নানা ঝক্কি ঝামেলায় সম্প্রতি তার গর্ভের ৪ মাসের একটি সন্তানও নষ্ট হয়ে যায়। সব কিছু মিলিয়ে তিনি নিজের জীবনের ঘানি আর টানতে চাননি। ট্রেনের নিচে মাথা দিয়ে জীবনের লেনাদেনা মিটিয়ে দিতে হাজির হন ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে।
বুধবার(১২ নভেম্বর) বেলা ১১টায় প্লাটফর্মে বসে ছিলেন। এ সময় রহমপুর থেকে মহানন্দা এক্সপ্রেস আসছিল। ওই ট্রেনের নিচেই মাথা দেয়ার প্রস্তুতি নেন তন্নী। প্লাটফর্মে ট্রেন ধীর গতিতে আসছিল। এ সময় তন্নী প্লাটফর্ম থেকে নিচে নেমে যান। মাথা নিচু করে ট্রেনের চাকার দিকে চলেও যান। আর বড়জোর ৫ সেকেন্ড, ট্রেনে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেতেন তখনই। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হন ঈশ্বরদীর জিআরপি থানার কনস্টেবল আব্দুর রহমান রানু। চোখের নিমিষে তন্নীকে হেঁচকা টানে বের করে আনেন। আত্মহত্যার মতো মহাপাপ থেকে বেঁচে যান তন্নী।
আব্দুর রহমান রানুর এমন কর্মে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সহকর্মীরা আবেগাপ্লুত। তন্নীকে অসুস্থ অবস্থায় বুধবার ঈশ্বরদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) পাবনা জেনারেল হাসপাতালে রেফার্ড করেন।
তন্নী পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার আলোবাগ মহল্লার ওয়াজেদ আলী বিশ্বাসের মেয়ে। তার বিয়ে হয় টাঙ্গাইল সদর উপজেলার আকুর টাকুর পাড়ার মাহবুব হাসান তন্ময়ের সঙ্গে।
শুক্রবার (১৩ নভেম্বর) সকালে তন্নীর মা ফরিদা খাতুন জেনারেল হাসপাতালে মেয়ের পাশে বসে জানান, তার ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে। তন্নী ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় তন্ময়ের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। তাদের ঘরে দুটি সন্তান রয়েছে। কিন্তু শুরু থেকেই তাদের সংসারে দাম্পত্য কলহ লেগেই রয়েছে।
তিনি জানান, তার জামাই তন্ময় মাদকাসক্ত হওয়ায় শুরুতেই শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক নিতে থাকেন। এরপর দিন দিন তার চাহিদা বাড়তেই থাকে। তার চাহিদা এক সময়ে মেটাতে না পারায় তন্নীর উপর নেমে আসে নির্যাতন। তন্নী বেশিরভাগ সময়ই বাবার বাড়ি বা অন্যান্য স্বজনদের বাড়িতে থাকতেন।
এ সময় তন্নী বলেন, আমি সবার বাড়ি গিয়েছি, কোথাও ভালো মুখ পাইনি। সবাই আমাকে অবহেলা করেছেন, সবাই রাগারাগি করেন।
তন্নীর মা ফরিদা খাতুন জানান, তন্নী ঘটনার দিন কাউকে কিছু না বলেই স্টেশনে গিয়েছিল। এতবড় ঘটনার পরও তার জামাই তন্নীর খোঁজ নেননি। তিনি জানান, অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে তন্ময়। অথচ নেশাটাই তার ও তন্নীর জীবন শেষ করে দিচ্ছে। তন্ময় আগে ব্যবসা করতেন। এখন শুধু নেশাতেই বুদ হয়ে থাকনে। স্ত্রী সন্তানদের কোনো খোঁজ তিনি নেন না।
তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘আমার মেয়েকে জামাই যেভাবে মারধর করে, মানুষ কোনো চোরকেও এভাবে মারে না।’
তন্নীর জীবন বাঁচানো পুলিশ সদস্য আব্দুর রহমানের জন্য দোয়া করে ফরিদা খাতুন বলেন, তার জন্য তন্নী আজ জীবিত। আর ওই পুলিশ সদস্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। মাত্র ৫ সেকেন্ড এদিক ওদিক হলে তার মেয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেত।
এদিকে আব্দুর রহমান রানু বলেন, তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন শুধুই একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য। ঘটনার সময় তার সাত-পাঁচ ভাবার সময় ছিল না। তাকে টান দিয়ে নিয়ে আসতে সফল হই।
ঈশ্বরদী জিআরপি থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রঞ্জন কুমার বিশ্বাস জানান, জিআরপি থানার পুলিশ সদস্য আব্দুর রহমান রানু যে ভূমিকাটি নিয়েছিলেন তা তার জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। একদিকে তার উপস্থিত বুদ্ধিতে অসহায় এক নারী আত্মহত্যা থেকে রক্ষা পেয়েছেন অন্যদিকে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে উদ্ধার কাজটি সম্পন্ন না হলে দু’জনই ট্রেনে কাটা পড়তেন। তবে দু’জনই অক্ষত থাকায় তারা খুশি এবং আব্দুর রহমান রানুর প্রশংসনীয় কাজের জন্য গর্বিত।
আমিন ইসলাম/এফএ/পিআর