বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে এলাকাবাসীর অনশন, এক কৃষকের মৃত্যু
অডিও শুনুন
দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার আশুরার বিলে বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ৭ দিন ধরে অনশনে থাকা কৃষক গোলাপ সরকার (৭৫) মারা গেছেন। এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অনশনরত অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়েন গোলাপ সরকার।
ওই অবস্থায় তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি মারা যান। শুক্রবার (৬ নভেম্বর) সকাল ১০টায় নামাজে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। অনশনকারীদের মধ্যে আরও ৫ জন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাদের স্থানীয় ভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
মৃত গোলাপ সরকার নবাবগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ ইউনিয়নের হরিপুর আদর্শ গ্রামের জব্বার সরকারের ছেলে। তিনি পেশায় কৃষক ছিলেন।
অপরদিকে, বাঁধ নির্মাণের পক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নবাবগঞ্জ বণিক সমিতি, কারিগরি মহাবিদ্যালয়, নবাবগঞ্জ উপজেলা ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, রিকশা ও ভ্যান চালক শ্রমিক ইউনিয়ন, ট্রাক ট্যাংকলরি কার্ভার ভ্যান ও ট্রাক্টর শ্রমিক ইউনিয়নসহ বেশ কিছু সংগঠন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের হাতে স্মারকলিপি প্রদান করেন।
গত ৩১ অক্টোবর শনিবার থেকে আশুরার বিলে বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে হরিপুর গ্রামের সহস্রাধিক নারী-পুরুষ-শিশু অনশন করছেন। ৬ নভেম্বর শুক্রবার সকাল থেকে নতুন করে মাথায় কাফনের কাপড় পড়ে অনশন শুরু করেছেন তারা।
বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে এলাকাবাসীর পক্ষে অনশনকারী রেজাউল ইসলাম জানান, আমরা গত শনিবার থেকে এখানে অনশন করছি। অনশন চলাকালীন গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গোলাপ সরকার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি মারা যান। এছাড়াও ৭ দিন ধরে অনশনে থাকা সিরাজুল ইসলাম, গফুর আলী, আইজুল ইসলাম, দিলবার আলী ও সাদেক আলী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাদেরকে স্যালাইন পুশ করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে আমরা এবং আমাদের পূর্ব পুরুষরা এই আশুরার বিলে বিভিন্ন ফসল আবাদ করে আসছি। কিন্তু আমাদের ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তির উপর সরকার বাঁধ নির্মাণ করেছে। যা নিয়ে আদালতে মামলা রয়েছে। চলতি বছরের ২টি বন্যায় বাঁধটি ভেঙে যায়। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর উপজেলা প্রশাসন থেকে আবারও বাঁধ নির্মাণ করার চেষ্টা করছে। আমরা বাঁধ নির্মাণ করতে দেব না। এই বাঁধ নির্মাণ করা হলে আমরা ওই জমিতে কোনো ধরনের ফসল উৎপাদন করতে পারবো না।
নবাবগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অশোক কুমার চৌহান জানান, ৭ দিন ধরে বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে অনশন ও নানা কর্মসূচি পালন করছে গ্রামবাসী। অনশনকারীদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। পরিবারের অভিযোগ না থাকায় তার ময়নাতদন্ত করা হয়নি।
৩নং গোলাপগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার জোবায়ের হোসেন সোহেল জানান, আমার এই ওয়ার্ডের এলাকাবাসী দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে আশুরার বিলে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করে আসছি। কিন্তু ২০১৯ সালে সরকার নবাবগঞ্জ শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যান সংস্কারের নামে স্থানীয় জনগণের ব্যক্তি মালিকানাধীন আশুরার বিলে অবৈধভাবে বাঁধ নির্মাণ করেন। সেই সময় এলাকার লোকজন বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদ জানালে ওই এলাকার ২৪ জন গ্রামবাসীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৩০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়।
বাঁধটি নির্মাণ হওয়ায় নবাবগঞ্জ, বিরামপুর ও ফুলবাড়ী উপজেলার প্রায় ৩৫ হাজার পরিবারের উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। চলতি বছর ২টি বন্যায় বাঁধটি ভেঙে গেলে কয়েকদিন আগে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাঁধ নির্মাণ করতে কয়েকটি স্কেভেটর মেশিন নিয়ে আসে। গ্রামবাসী বাঁধ নির্মাণে বাধা দিয়ে ৭ দিন ধরে সেই বাঁধের উপর অনশন ও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন।
জানা যায়, ২০১০ সালে নবাবগঞ্জ উপজেলার শালবনকে শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে উদ্যানের ভেতর দৃষ্টিনন্দন ৯শ মিটার দীর্ঘ আঁকাবাঁকা শেখ ফজিলাতুন্নেছা কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়। ওই বছর বিলের পানি রক্ষায় বগুড়া ও দিনাজপুর জেলা ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নির্বাহী প্রকৌশল ও বিএডিসি’র যৌথ উদ্যোগে উদ্যানের পূর্ব পাশে ১৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ক্রসড্যাম নির্মাণ করা হয়।
এছাড়াও চলতি বছর উদ্যানের পর্যটকদের সুবিধার জন্য ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে গোলচত্ত্বর, শৌচাগার, রাস্তার উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয়।
ক্রসড্যাম নির্মাণের পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে আশুরার বিলেও অবৈধ জমি দখলচক্রের লোকজন বাঁধটি কেটে দেয়। এরপর দিনাজপুর জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ করে বাঁধটি মেরামত করেন। কয়েকমাস আগে বন্যায় ক্রসড্যামের পাশে নির্মাণ করা বাঁধটি আবারও ভেঙে যায়। স্থানীয় প্রশাসন গত কয়েক দিন আগে ভেঙে যাওয়া বাঁধটি মেরামতের উদ্যোগ নিলে সেখানে ভূমি দখলকারীরা বাধা প্রদান করে।
জানতে চাইলে শেখ রাসেল জাতীয় বন রক্ষাকমিটির সভাপতি মো. মাহাবুর রহমান বলেন, স্থানীয় একটি চক্র বেশ কিছুদিন থেকে উদ্যানের পাশের আশুরার বিলের জমিগুলো দখল করেছিল। স্থানীয় প্রশাসন সেই জমিগুলো উদ্ধার করে বিলের পানি ধরে রাখার জন্য ক্রসড্যাম নির্মাণ করে। এতে শুরু থেকেই চক্রটি বাধা দিয়ে আসছিল। তারা সরকারের কোনো উন্নয়ন চায় না।
নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছা. নাজমুন নাহার বলেন, স্থানীয় একটি চক্র জাতীয় উদ্যান ও আশুরার বিলে উন্নয়নের কাজে দীর্ঘদিন থেকে বাধা দিয়ে আসছে। বিলকে ঢেলে সাজাতে ইতোমধ্যে সরকার নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
তিনি বলেন, জাতীয় উদ্যান ও আশুরার বিলকে নিয়ে সরকারের সকল উন্নয়ন বাস্তবায়ন হলে এ এলাকার অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
প্রসঙ্গত, আশুরার বিলের ১৯শ হেক্টর সরকারি জমি দখল করে চাষাবাদ করে আসছে হরিপুর গ্রামের বাসিন্দারা। যা বর্তমানে তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। আর তা নিয়েই পক্ষে বিপক্ষে আন্দোলন শুরু হয়েছে।
এমদাদুল হক মিলন/এমএএস/পিআর