করোনাঘাতে শতবর্ষী শুটকি পল্লীতে অচলাবস্থা
অডিও শুনুন
অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর গ্রামের শুটকি পল্লীতে কাজ চলে পুরোদমে। প্রতিবছর শতবর্ষী এ শুটকি পল্লী থেকে প্রায় দেড়শ কোটি টাকার শুটকি বাজারজাত করা হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে শুটকি বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মহামারিতে অবিক্রিত থাকা শুটকি নষ্ট হয়ে অন্তত ১২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। এর ফলে পুঁজি সংকটে নতুন মৌসুমের জন্য শুটকি তৈরি করতে মাছ কিনতে পারছেন না তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শতবছর ধরে লালপুর গ্রামের শুটকি পল্লীতে শুটকি তৈরি করে আসছেন স্থানীয়রা। গ্রামের মেঘনা নদীর পূর্বপাড়ে ছোট-ছোট মাঁচায় শুকানো হয় এসব শুটকি। গুণগত মান বজায় থাকায় এখানকার শুটকির কদর সবখানে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাতকরণের পাশাপাশি ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি হয় লালপুরের শুটকি।
মূলত দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছের শুটকি তৈরি হয় লালপুর শুটকি পল্লীতে। এর মধ্যে পুঁটি, শৈল, টাকি, ট্যাংরা ও বাইম অন্যতম। এছাড়া বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ কিনে এনেও শুটকি তৈরি করা হয় এখানে।
বর্তমানে আকার ভেদে প্রতি কেজি শৈল শুটকি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা পর্যন্ত। টাকি শুটকি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা, বাইম শুটকি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা আর ট্যাংরা শুটকি প্রতি কেজির দর ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত।
বর্তমানে লালপুর শুটকি পল্লীর কয়েকশ পরিবার শুটকি কারবারের সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে কেউ মাছ কিনে শুটকি ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করেন, কেউবা মাছ প্রক্রিয়াজাত করে শুটকি উৎপাদনের কাজ করেন।
আর এ পল্লীতে ছোট, মাঝারি ও বড় মিলিয়ে ব্যবসায়ী আছেন তিন শতাধিক। ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সমিতি ও এনজিওর কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে ব্যবসা করেন। আর বড় ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন ব্যাংক ঋণ নিয়ে। তবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে ব্যবসা মন্দা হওয়ায় সব ব্যবসায়ীরাই এখন ঋণগ্রস্ত।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত শুটকি ব্যবসার মৌসুম ধরা হয়। বছরের এই সময়টাতে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায় বাজারে। আর এসব মাছ সংগ্রহ করেই চলে শুটকি তৈরির কাজ। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়ে তৈরিকৃত শুটকির মধ্যে কিছু শুটকি স্টকে রাখা হয় বছরের বাকি ছয়মাস বাজারজাতকরণের জন্য।
কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের কারণে অধিকাংশ শুটকি বাজারজাত করা যায়নি। দীর্ঘদিন গুদামে পড়ে থাকার কারণে বেশিরভাগ শুটকি নষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে কিছু শুটকি আছে যেগুলো মাস তিনেকের বেশি সংরক্ষণ করা যায় না।
শুটকি ব্যবসায়ী সুকমল দাস বলেন, করোনাভাইরাসের আগে স্টক করা বেশিরভাগ শুটকি এখন পড়ে আছে। পাইকাররা শুটকি পল্লীতে আসছেন না শুটকি নিতে। স্টকে এখনও ১০-১২ লাখ টাকার শুটকি আছে। এই শুটকিগুলো ৩-৪ লাখ টাকা লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হবে।
তিনি বলেন, এখন হাতে টাকা নেই। সেজন্য নতুন মাছ কিনতে পারছি না। আমাদের এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রয়োজন।
সুমন দাস নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, স্টক করা শুটকিগুলো অর্ধেক দরেও বিক্রি করতে পারছি না। আমাদের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। আমার প্রায় ১০-১২ লাখ টাকার লোকসান হবে। টাকার অভাবে আমরা এবারের মৌসুমের জন্য মাছ কিনতে পারছি না। এতে করে মৌসুমের প্রথম দিকেই শুটকি তৈরির কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যাংকার্স ফোরামের সভাপতি ইকবাল হোসেন ভূইয়া বলেন, করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য চার শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ব্যবসায়ীরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা তাদেরকে ঋণ দিতে পারব। সেজন্য জামানত লাগবে। আর যদি জামানত না থাকে, তাহলে উপযুক্ত কেউ একজন ঋণগ্রহীতার জিম্মাদার হতে হবে।
আজিজুল সঞ্চয়/এফএ/এমএস