ফিরেছে সম্প্রীতি তবে বিচার হয়নি এখনও
‘সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে ১৫-২০ জন আসে মন্দিরের সামনে। সবার হাতে দা, লাঠিসোটা ও রড ছিল। আমাকে সংকেত দিয়েছিল- মার খেতে না চাইলে আমি যেন চলে যাই। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই মন্দিরের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে এক এক করে মূর্তিগুলো ভাঙতে থাকে। ছোট ছোট কিছু স্বর্ণ এবং পিতলের মূর্তি ছিল, সেগুলো তারা নিয়ে যায়। সেদিনের ভয়ানক সেই স্মৃতি আজও ভুলতে পারিনি। সবকিছু যেন ভূমিকম্পের মতো হয়েছে’ এভাবেই চার বছর আগে হিন্দুপল্লীতে হওয় হামলার বর্ণনা দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা সদরের জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিত নরেন্দ্র চক্রবর্তী।
ইসলাম ধর্মকে অবমাননার অভিযোগে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলা সদরের হিন্দুপল্লীতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় পৃথক আটটি মামলা দায়ের করা হয় নাসিরনগর থানায়। কিছু আসামি গ্রেফতার হলেও এখন তারা জামিনে আছেন।
দেশ-বিদেশে আলোচিত এই হামলায় জড়িতদের বিচারের অপেক্ষায় দিন কাটছে ক্ষতিগ্রস্তদের।
সেদিনের সেই তাণ্ডবে চার বছর পেরিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে আগের সেই সম্প্রীতিও ফিরে এসেছে। কিন্তু চার বছরেও আলোচিত এই হামলার বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
ঘটনা সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ফেসবুক আইডি থেকে পবিত্র কাবা শরিফকে ব্যাঙ্গ করে একটি পোস্ট দেয়া হয়। এ নিয়ে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলে ২৯ অক্টোবর রসরাজকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু রসরাজ তখন পুলিশের কাছে ওই পোস্ট করেননি বলে দাবি করেন।
পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করার অভিযোগ তুলে রসরাজের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে নাসিরনগর। ৩০ অক্টোবর উপজেলা সদরে দুইটি ইসলামী সংগঠন সমাবেশ ডাকে।
ওই সমাবেশ শেষে হিন্দু অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকায় হামলা চালিয়ে অন্তত ১০টি মন্দির ও শতাধিক ঘর-বাড়ি ভাঙচুর এবং লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা। এরপর ৪ নভেম্বর ও ১৩ নভেম্বর দুই দফায় হিন্দুদের অন্তত ছয়টি ঘর-বাড়িতে দুর্বৃত্তরা অগ্নিসংযোগ করে।
হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় থানায় পৃথক আটটি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় অজ্ঞাত দুই হাজারেরও বেশি মানুষকে আসামি করা হয়। মামলা দায়েরের পরপরই হামলার ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে ১২৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ঘটনার ১৩ মাস পর ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর নাসিরনগর উপজেলা সদরের গৌরমন্দির ভাঙচুর মামলায় নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হাশেম ও হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখিসহ ২২৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। তবে ঘটনার চার বছর পেরিয়ে গেলেও বাকি সাত মামলার তদন্ত কাজ এখনও শেষ করতে পারেনি পুলিশ।
নাসিরনগর উপজেলা সদরের দত্তবাড়ি মন্দির ভাঙচুর মামলার বাদী কাজল জ্যোতি দত্ত বলেন, আমার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেছেন গৌরমন্দির মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আমার মামলার অভিযোগপত্রও দেয়া হবে। এ বলেই আমাকে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে। তবে আমাদের মধ্যে সম্প্রীতি ফিরে এসেছে। আমাদের কারো প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই। আমরা চাই যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের যেন বিচার হয়।
স্থানীয় গৌর মন্দির পরিচালনা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রতন কুমার দাস বলেন, কী কারণে আমাদের মন্দির ও ঘরবাড়ি ভাঙা হলো সেটি আমরা আজও জানতে পারলাম না। চার বছরেও আমরা বিচার পাইনি। এখনও আমরা বিচারের অপেক্ষায় আছি। আমরা চাই হামলায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।
নাসিরনগর উপজেলা সদরের দত্তপাড়া এলাকার বাসিন্দা বলরাম দত্ত বলেন, তারা (দুর্বৃত্তরা) সভা থেকে এসে আমাদের মন্দির ও বাড়িতে হামলা চালায়। দেয়াল টপকে তারা বাড়িতে ঢোকে। আশপাশের মুসলামানরা আমাদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। আমরা চেষ্টা করছি হামলার কথা ভুলে থাকার জন্য। কিন্তু চেষ্টা করলেও ভোলা যায় না। দেশে কোনো বিচারই তো আমরা দেখি না। আমরা যেন সবার সঙ্গে একত্রে ভালোভাবে চলতে পারি সেটিই এখন আমাদের চাওয়া।
নাসিরনগর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অনাথ বন্ধু দাস বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক অবদান আছে। আমরাও এ দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটাবে আর আমরা বিচার পাব না, সেটি মেনে নেব না। আমরা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি চাই।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাসিরনগর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এটিএম আরিচুল হক বলেন, মামলাগুলো খুবই স্পর্শকাতর। সেজন্য মামলা সংক্রান্ত প্রতিটি বিষয় আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করছি। হামলায় জড়িতদের আইন অনুযায়ী অবশ্যই বিচার হবে। আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতা এবং পেশাদারিত্ব দিয়ে মামলাগুলোর তদন্ত করছি। আশা করছি দ্রুত তদন্ত কাজ শেষ করে আদালতে সবগুলো মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয়া হবে।
এফএ/এমএস