সেই পুকুরটি এখন কুড়িগ্রামবাসীর ফুসফুস
দীর্ঘদিন ধরে অযত্ন-অবহেলায় পড়েছিল পার্ক ও পুকুরটি। পরিত্যক্ত পুকুর পাড়ে উদ্বাস্তু ও নেশাখোরদের আড্ডা ছিল। সেই পরিত্যক্ত পার্ক ও পুকুরটি এখন আলো ঝলমলে। নান্দনিক রূপে রংধনু ভেসে বেড়ায়। বলতে গেলে পুকুরটি এখন কুড়িগ্রামবাসীর ফুসফুস।
পরিত্যক্ত পার্ক ও পুকুরটিকে সাজিয়ে তোলার কথা ভাবেন কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীন। ভাবনা অনুযায়ী পুকুর ও পার্কটি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। কুড়িগ্রামবাসীর কথা চিন্তা করে পুকুর ও পার্কটি পরিচ্ছন্ন এবং নান্দনিক করে গড়ে তোলেন তিনি। বর্তমানে পুকুর ও পার্কটি দৃষ্টিনন্দন।
দৃষ্টিনন্দন পুকুর ও পার্কটি এখন জেলা শহরের শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের প্রিয় স্থান। ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্ত চাপে ভোগা রোগীদের ফুসফুস হয়ে উঠেছে পার্কটি। বৃদ্ধদের হাঁটাচলার নিরাপদ স্থান হয়ে উঠেছে একসময়ের জরাজীর্ণ ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ থাকা পুকুরপাড়।
স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের নিয়মিত ব্যায়ামের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে পুকুরপাড়টি। বিনোদনপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসু মানুষের প্রিয়স্থান হয়ে উঠেছে একসময়ের অনিরাপদ পার্কটি।
প্রতিদিন বিকেল হলেই দৃষ্টিনন্দন পুকুরপাড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভিড় জমান দর্শনার্থীরা। শহরের কর্মব্যস্ত মানুষগুলো পার্কের নির্মল পরিবেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছেন। পার্কে বসে আড্ডা কিংবা ঘোরাঘুরি করে নিজেদের সতেজ করে নিচ্ছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭৮ সালে কুড়িগ্রাম শহরে পুকুরটি খনন করা হয়। পুকুরটি খননের পর নামকরণ করা হয় নিউটাউন পার্ক। কুড়িগ্রাম কালেক্টরেট ভবন ও জজ কোর্ট ভবনের মধ্যবর্তী স্থানে পুকুরটির অবস্থান।
পুকুরটির চারপাশজুড়ে পার্ক। দীর্ঘদিন ধরে অযত্ন-অবহেলায় পড়েছিল পার্ক ও পুকুরটি। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় বিভিন্ন সময়ে পুকুরপাড়ের পার্কে অসামাজিক কার্যকলাপ চলতো। একই সঙ্গে উদ্বাস্তু ও নেশাখোরদের আড্ডা জমতো।
বিষয়টি নজরে আসার পর পুকুর ও পার্কটি সংস্কারের উদ্যোগ নেন কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীন। পুকুরের চারপাশে সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নেন তিনি। ব্যতিক্রমী পরিকল্পনায় পুকুর ও পার্কটি দ্রুত সংস্কার করা হয়। একই সঙ্গে নান্দনিক রূপে সাজানো হয়। পুকুর ও পার্কটির নান্দনিক রূপ দেখে অবাক হন সবাই। এমন কাজের জন্য ডিসির প্রশংসা করেন অনেকেই।
কুড়িগ্রাম কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হারুন-অর-রশিদ বলেন, একটি পরিত্যক্ত পুকুর ও পার্ককে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলা অনেক কঠিন কাজ। গণমানুষের জন্য এটিকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা ছিল আরও কঠিন কাজ। এমন কঠিক বাস্তবায়ন করেছেন সুলতানা পারভীন ম্যাডাম। তাকে ধন্যবাদ।
কুড়িগ্রামের শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী আব্দুল জলিল বলেন, এই পুকুরপাড়ে অনেক জঙ্গল ছিল। পার্কের কোনো অবস্থাই ছিল না। সংস্কারের পর শহরবাসীর হাঁটাচলা ও আড্ডার জন্য পুকুরপাড় ও পার্কটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। সকাল-বিকেল এখানে শরীর চর্চা হয়। পুকুরপাড় আরও সংস্কার করা দরকার। বসার আরও কিছু জায়গা, পার্কে আরও গাছ লাগিয়ে সৌন্দর্যবর্ধন করলে অসাধারণ লাগতো।
জেলা শহরের মন্ডলপাড়া প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক বলেন, আমরা এখানে প্রতিদিন মর্নিংওয়ার্কে আসি। পার্ক ও পুকুরটির আগে এত সুন্দর পরিবেশ ছিল না। এখন এটি অনেক সুন্দর হয়েছে। সকালে যারা ব্যায়াম করেন তাদের জন্য এটি দারুণ উপযোগী স্থান। এখানে প্রতিদিন অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ ব্যায়াম করেন।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত আফছার আলী বলেন, খোলামেলা জায়গা শহরে নেই বললেই চলে। নিউটাউন পার্ক ও পুকুরটি এখন দেখার মতো। পুকুরের পাশে হাঁটার পথ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগী ও শিশু-কিশোরদের ব্যায়ামের জন্য এটি উপযুক্ত স্থান।
কুড়িগ্রামের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী নিত্য বর্মণ বলেন, সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন এখানে সুন্দর একটি পরিবেশ তৈরি করেছেন। কুড়িগ্রামে এমন স্থান আর নেই। বৃদ্ধ ও যুবকদের হাঁটাচলার জন্য এখানে সুন্দর পরিবেশ তৈরি করেছেন সাবেক ডিসি। পাশাপাশি এখানে একটি ওয়াশরুম ও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা হলে আরও উপকৃত হবে দর্শনার্থীরা।
পার্কে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থীরা জানান, পুকুর ও পার্কটি সংস্কার হওয়ায় আমরা অনেক উপকৃত হয়েছি। কারণ মর্নিংওয়ার্কের জন্য নিয়মিত এখানে আসি আমরা। বিকেলে একটু সময় আড্ডা দিতেও আসি আমরা।
কুড়িগ্রামের রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী প্রদীপ কুমার রায় বলেন, কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীন যেসব ভালো কাজ করেছেন তার মধ্যে একটি হলো শহরের পুকুর ও পার্কটির সংস্কার। এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।
তিনি বলেন, পুকুরটি সংস্কারের পর নতুন নামকরণের প্রস্তাব এসেছিল। তখন আমরা গণকমিটি পুকুরটির নামকরণ ভাওয়াইয়া করতে প্রস্তাব করেছিলাম। ভাওয়াইয়া গান আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক। কিন্তু ডিসি সুলতানা পারভীন পুকুরপাড়ে থাকা কিছু জারুল গাছ কেটে ফেলেছেন, তা ঠিক হয়নি। তবে সংস্কারের পর পুকুরপাড়ে কিছু ফলের গাছ লাগানো উচিত ছিল তার।
কুড়িগ্রামের বর্তমান জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, শহরের পুকুরটির সৌন্দর্যবর্ধনে সরকারিভাবে কোনো বরাদ্দ নেই। তবে পুকুরটির সৌন্দর্যবর্ধনে জেলা প্রশাসন থেকে কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। যেগুলো পর্যায়ক্রমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে বাস্তবায়ন করা হবে।
>> তথ্য ও ভিডিও মাসুদ রানা
এএম/এমএস