ফাঁড়িতেই বিনা চিকিৎসায় রাখা হয় আহত রায়হানকে
অডিও শুনুন
রোববার রাত ৩টায় আহত অবস্থায় রায়হান উদ্দিনকে উদ্ধার করে সিলেট নগরের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে এনে রাখে পুলিশ। আহত হওয়ার পরও তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য না পাঠিয়ে পুলিশ ফাঁড়ির হাজতে রেখে দেয়া ও আইনগত পদ্ধতি অনুসরণ না করার অভিযোগ পেয়েছে সিলেট মহানগর পুলিশ (সিএমপি) গঠিত তদন্ত কমিটি।
কমিটি গঠনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন পেয়েই সোমবার (১২ অক্টোবর) ফাঁড়ির ইনচার্জে এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করেছে এসএমপি।
সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ জাগো নিউজকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, রোববার (১১ অক্টোবর) বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে আখালিয়া এলাকার রায়হান উদ্দিনের মৃত্যু হয়েছে- এমন অভিযোগ পেয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া স্যার তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির প্রধান করা হয় এসএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর) শাহরিয়ার আলম মামুনকে। কমিটিতে কোতোয়ালি মডেল থানার সহকারী পুলিশ কমিশনার নির্মলেন্দু চক্রবর্তী ও এয়ারপোর্ট থানার সহকারী পুলিশ কমিশনার প্রভাষ চন্দ্রকে সদস্য করা হয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই শাস্তিমূলক এই ব্যবস্থা নেয় এসএমপি।
তবে এই পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেন, গত শনিবার (১০ অক্টোবর) দিবাগত রাতের কোনো এক সময় নগরীর কাষ্টঘর এলাকায় রায়হান উদ্দিনকে ছিনতাইকারীরা মারধর করে। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে রাত ৩টার দিকে রায়হানকে উদ্ধার করে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নিয়ে আসে।
আহত থাকায় প্রথমেই রায়হানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা তাকে আহত অবস্থায় ফাঁড়িতে রেখেই আইনি প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করেন। পরে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এ কারণেই দায়িত্বে অবহেলা হয়েছে। তাই সোমবার চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়।
সাময়িক বরখাস্ত চার পুলিশ সদস্য হলেন- বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাস। আর প্রত্যাহার তিন পুলিশ সদস্য হলেন- এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেন।
এদিকে সদ্য সাময়িক বরখাস্ত হওয়া বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া রোববার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘রায়হানকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসাই হয়নি। ফাঁড়িতে নিয়ে আসার বিষয়টি সত্যি নয়। তাকে কাস্টঘর এলাকায় গণপিটুনি দেয়া হয়। খবর পেয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
তবে ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর হোসেন এবং এসএমপির উপ-কমিশনার আজবাহার আলী শেখ কাস্টঘরে রায়হান উদ্দিন হামলার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করলেও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সিসিটিভির ফুটেজে ওই এলাকায় এমন কোনো ঘটনার সত্যতা মেলেনি।
নগরের কাষ্টঘর এলাকা সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ১৪ নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। এই এলাকার পুরোটাই সিসিটিভির আওতাভুক্ত। এসব ক্যামেরার মনিটর রয়েছে ১৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মুনিমের কার্যালয়ে।
রোববার রাতে মুনিমের কার্যালয়ে গিয়ে শনিবার রাত ১২টা থেকে রোববার সকাল ৭টা পর্যন্ত কাষ্টঘর এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখা হয়। এসব ফুটেজে কোনো গণপিটুনির দৃশ্য দেখা যায়নি।
কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মুনিম বলেন, আমাদের সিসিটিভির ফুটেজ দেখেছি। শনিবার রাত থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত কাষ্টঘর এলাকার ফুটেজে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি।
আর এ কারণেই নিহত যুবক রায়হানের মৃত্যু নিয়ে রহস্য কাটছে না। প্রথম থেকেই নিহতের পরিবার ও পুলিশের পক্ষ থেকে পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য। পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্যের মধ্যেও আছে অনেক অসঙ্গতি।
গত রোববার সকালে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপতালে রায়হান উদ্দিন মারা যান। তিনি সিলেট নগরের আখালিয়া নেহারিপাড়া এলাকার বাসিন্দা।
পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন রায়হান।
বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান উদ্দিনকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে নিহতের পরিবার। এ ঘটনায় রোববার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, প্রতিদিনের মতো গত শনিবার (১০ অক্টোবর) বিকেল ৩টার দিকে রায়হান আহমদ নিজ কর্মস্থল নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটের ডা. গোলাম কিবরিয়া ও ডা. শান্তা রানীর চেম্বারে যান। পরদিন রোববার (১১ অক্টোবর) ভোর ৪টা ৩৩ মিনিটে ০১৭৮৩৫৬১১১১ মোবাইল নম্বর থেকে রায়হানের মা সালমা বেগমের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে কল দিলে সেটি রিসিভ করেন রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ।
এ সময় রায়হান আর্তনাদ করে বলেন, তিনি বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাকে বাঁচাতে দ্রুত টাকা নিয়ে বন্দর ফাঁড়িতে যেতে বলেন রায়হান। এ কথা শুনে রায়হানের চাচা ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে রায়হান কোথায় জানতে চাইলে দায়িত্বরত একজন পুলিশ সদস্য বলেন, সে ঘুমিয়ে গেছে। আর যে পুলিশ সদস্য রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছেন তিনিও চলে গেছেন। এ সময় হাবিবুল্লাহকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসার কথা বলেন ওই পুলিশ সদস্য।
পুলিশের কথা মতো হাবিুল্লাহ আবারও সকাল পৌনে ১০টার দিকে ফাঁড়িতে গেলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর রায়হানের চাচা ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা যান। এ সময় হাবিবুল্লাহ পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনকে খবর দিলে তারা গিয়ে ওসমানীর মর্গে রায়হানের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ দেখতে পান।
এজাহারে মামলার বাদী উল্লেখ করেন, আমার স্বামীকে কে বা কারা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে আমার স্বামী মৃত্যুবরণ করেন।
ছামির মাহমুদ/আরএআর/জেআইএম