নাটোরের ২ চিনিকলেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা
বিপুল টাকা লোকসানের দায়ভার মাথায় নিয়েই নাটোরের দুটি চিনিকলের ২০১৫-১৬ আখ মাড়াই মৌসুুম শুরু হচ্ছে। ইতোমধ্যে গত ৩০ নভেম্বর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বােধন করা হয়েছে। আগামী শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে নাটোর চিনিকলের আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন করা হবে।
এর আগে গত পাঁচ বছরে চিনিকল দুটি প্রয়োজনীয় আখের অভাবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারায় প্রায় ১৫০ কোটি টাকার বেশি লোকসান করেছে। চিনিকল কর্তৃপক্ষ জানায়, চিনিকল এলাকায় অবৈধ বিদ্যুৎ চালিত ক্রাশার মেশিনে আখ মাড়াই করে গুড় তৈরি, আখের স্বল্পতা এবং উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে চিনির দাম নির্ধারণ করায় চিনিকল দুটিকে এই লোকসান গুণতে হয়েছে।
চলতি মৌসুমে প্রয়োজনীয় আখ না পেলে চিনিকল আবারো লোকসান করবে। অপরদিকে, মিল দুটির গত চার বছরে উৎপাদিত চিনি দফায় দফায় মূল্য কমানোর পরও এখনো অবিক্রিত রয়েছে ২২ হাজার ৪৬৫ মেট্রিকটন। মিল গেটে ৩৭ হাজার টাকা মেট্রিকটন হিসেবে সরকার নির্ধারিত বর্তমান মূল্যে ৮১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বিক্রি না হওয়ায় স্থানাভাবে চিনিকল দুটির চিনি অন্য মিলে রাখা হয়েছে।
ইতোমধ্যে গত ৩০ নভেম্বর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন করেন শিল্প মন্ত্রী আমি হোসেন আমু । এছাড়া ৬ নভেম্বর শুক্রবার নাটোর চিনিকলের আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন হতে যাচ্ছে।
নাটোর চিনিকল সুত্রে জানা যায়, এবার ৮০ মাড়াই দিবসে এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিকটন আখ মাড়াই করে ৯ হাজার ৩শ মেট্রিকটন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চিনি আহরণের গড় হার ধরা হয়েছে ৭.৭৫। মিলটিতে গত মৌসুমে উৎপাদন হয়েছিল ছয় হাজার ৯৭১ মেট্রিকটন চিনি। যার মধ্যে এখনো অবিক্রিত আছে চার হাজার ৯৬৫ মেট্রিকটন। এর আগের চার বছরে উৎপাদিত চিনির মধ্যে নাটোর চিনিকলের গোডাউনে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় পাবনা চিনিকলের গোডাউনে রাখা চিনি এখনো অবিক্রিত রয়েছে। সব মিলিয়ে মিলটিতে অবিক্রিত রয়েছে ছয় হাজার ৩০৫ মেট্রিকটন চিনি।
নাটোর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল রফিক জাগো নিউজকে বলেন, মিল জোন এলাকায় বিপুল পরিমাণ আখ উৎপাদিত হলেও সরকার নির্ধারিত আখের চেয়ে ক্রাশার মালিকরা বেশি দামে আখ কেনায় চিনিকলে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় আখ পাওয়া যাচ্ছে না। চাষিরাও অধিক দামের কারণে মিলে আখ সরবরাহ না করে ক্রাশার মালিকদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এ অবস্থায় অবৈধ বিদ্যুৎ চালিত ক্রাশার মেশিনে আখ মাড়াই বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় মিল কতৃপক্ষ উদ্যোগ নিচ্ছেন। এ উদ্যোগ সফল হলে আশা করা যায় চিনিকলটি তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
মহাব্যবস্থাপক কৃষি আখতার হোসেন জাগো নিউজকে জানান, প্রতিদিন মিল জোন এলাকায় ২৬৬টি অবৈধ বিদ্যুৎচালিত ক্রাশার মেশিনে আখ মাড়াই চলছে। চিনিকল কর্তৃপক্ষ সরকার নির্ধারিত মিলগেটে প্রতিমণ আখ একশ টাকা এবং মিল গেটের বাইরে ৯৭.৫০ টাকা মণ দরে আখ ক্রয় করছে। কিন্তু অবৈধ ক্রাশার মালিকরা ১২০ থেকে ১৪০ টাকা মণ দরে আখ কিনছে। এ কারণে মাঠে আখ থাকলেও চাষিরা বেশি দামের আশায় চিনিকলে আখ সরবরাহে অনীহা বোধ করেন।
বড়বাড়ীয়া কেন্দ্রের কৃষক আব্দুল বারেক, আব্দুল খালেক ও রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, কৃষক যেখানে বেশি লাভ পাবে সেখানেই আখ বিক্রি করবেন এটাই স্বাভাবিক। আখ চাষি নেতা মসলেম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ফসলের বহুমুখী করণের কারণে কৃষকরা তাড়াতাড়ি আখ কেটে ওই জমিতে অন্য ফসল করতে চায়। অপরদিকে, ক্রাশার মালিকরা বেশি দাম দেয়ায় কৃষকরা বেশি দাম পাচ্ছেন এবং অন্য ফসল উৎপাদনের স্বার্থে অবৈধ ক্রাশার মালিকদের কাছে আখ বিক্রি করেছেন।
অপরদিকে, গত মৌসুমে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে গত কয়েক বছরের উৎপাদিত চিনির মধ্যে এখনো অবিক্রিত রয়েছে ১৬ হাজার ১৬০ মেট্রিকটন। মিলের গোডাউনে জায়গা না হওয়ায় মিলের মহাব্যবস্থাপকের বাসা, আনসার ব্যারাক, ট্রেনিং সেন্টার ও লেডিস ক্লাবসহ প্রায় সব ভবনেই রাখা হয়েছে এসব অবিক্রিত চিনি। এবার ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদিত আখের মধ্যে ১২০ মাড়াই দিবসে প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার মেট্রিকটন আখ মাড়াই কর ১৯ হাজার মেট্রিকটন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা নিয়ে গত শুক্রবার ২০১৫-১৬ মৌসুমের আখ মাড়াই উদ্বোধন করা হয়েছে। চিনি আহরণের গড় হার ধরা হয়েছে ৮.১৫।
গত কয়েক বছরের মতো এবারও মাড়াই শুরু হওয়ার এক মাস আগে থেকেই দুটি মিল এলাকায় প্রায় তিনশ অবৈধ পাওয়ার ক্রাশারে এক হাজার মেট্রিকটনের বেশি আখ মাড়াই করে চলেছে। এছাড়া পাওয়ার ক্রাশারের সংখ্য দিনদিন বাড়ছে। চাষিরা নগদ টাকার জন্য মিলে আখ না দিয়ে এসব পাওয়ার ক্রাশারে কম দামেই আখ বিক্রি করছেন। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারলেও মিল দুটিকে এবারো কোটি কোটি টাকা লোকসান গুণতে হবে।
এ বিষয়ে নর্থবেঙ্গল চিনিকলের আখচাষি নেতা আনসার আলী দুলাল জাগো নিউজকে বলেন, আমরা কৃষকদের কথা ভেবে আখের দাম বাড়ানো এবং নিয়মিত বিল পরিশোধের দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু সে দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। এ অবস্থায় কৃষকরা বেশি লাভের আশায় অন্যত্র আখ বিক্রি করছেন। অন্যদিকে এবার উৎপাদিত চিনি কোথায় রাখা হবে তা নিয়েও চিন্তিত দুটি মিল কর্তৃপক্ষ।
তবে নাটোর সুগার মিলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) মো. আখতার হোসেন জাগো নিউজকে বলেছেন তাদের মিলের উৎপাদিত চিনি রাখতে কোনো সমস্যা হবে না, কারণ হিসেবে তিনি বলেন, উৎপাদনের পাশাপাশি কিছু চিনি বিক্রিও হচ্ছে, সেহেতু সমস্যা হবে না বলেই তারা ধারণা করছেন।
তিনি আরও জানান, পাওয়ার ক্রাশার বন্ধের জন্য চাষিদের নিয়ে উঠান বৈঠক, বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং, পোস্টারিং ও প্রচারপত্র বিলি করা হচ্ছে। এতে আশা করা হচ্ছে, সুগারমিলটি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সক্ষম হবে।
নাটোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আমিনুল হক বলেছেন, সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া চিনি শিল্প বাংলাদেশে টিকতে পারবে না। দেশে শীতের এই মৌসুমে এক কেজি পুইশাকের দাম ৫০ টাকা অথচ এক কেজি চিনির দাম ৩৭ টাকা। তারপরও চিনি বিক্রি না হওয়ায় মাঝে মাঝেই চিনির দাম কমানো হচ্ছে। চিনির দাম না কমিয়ে সরকার বিদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করলেই দেশের বৃহত্তম এই চিনি শিল্প টিকে যেতে পারে। অন্যথায় এই শিল্পের ধ্বংস অনিবার্য।
রেজাউল করিম রেজা/এমজেড/পিআর