বৃহত্তম বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করতে গিয়ে আর্থিক সঙ্কটে উদ্যোক্তারা

ইউসুফ দেওয়ান রাজু
ইউসুফ দেওয়ান রাজু ইউসুফ দেওয়ান রাজু সিরাজগঞ্জ
প্রকাশিত: ০৪:৪১ পিএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার সদর ইউনিয়নের অবহেলিত একটি গ্রাম রাণীপুরা। গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা নদীর একটি খরস্রোতা শাখা। শুকনো মৌসুমে নদী দিয়ে হেঁটে পারাপার সম্ভব হলেও বর্ষাকালে দুর্ভোগের সীমা থাকে না। তাছাড়া একটু বৃষ্টি হলেই দুই পাড়ে দীর্ঘ মেঠো পথে পানি জমে যায়। তাই স্থানীয়দের অনুদান, গ্রামবাসীদের চাঁদা ও বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে এক হাজার ৩৩ ফুট দীর্ঘ বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের দীর্ঘতম এই বাঁশের সাঁকোটি নির্মাণে বিভিন্ন উৎস থেকে গৃহীত ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় এখন মানসিক চাপে রয়েছেন এর উদ্যোক্তারা। দ্রুত ঋণ পরিশোধের জন্য সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন রাণীপুরা গ্রামবাসী।

সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রামটির ভেতর দিয়ে যাওয়া পায়ে চলা রাস্তায় শুকনো মৌসুমে বেলকুচি সদর ইউনিয়নের রানীপুরা, দেলুয়া, মনতলা, বেলকুচির চর, মুলকান্দী, কালাই, আফজালপুর, হাট বয়ড়া, ছোট বেড়া, খারুয়া, দশখাদাসহ বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ১০ হাজারেরও অধিক মানুষ যাতায়াত করে। নদীঘেঁষা এই গ্রামের অধিকাংশ জায়গা বর্ষায় পানিতে ডুবে গেলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। সেই সঙ্গে লোকজনের যাতায়াতেও বিঘ্ন ঘটে। বর্ষার সময় শিক্ষার্থীদের গামছা পরে মাথায় বই-পুস্তক নিয়ে গলা পানিতে হেঁটে হেঁটে, কোথাও কোথাও আবার সাঁতরে স্কুলে যেতে হয়। এছাড়াও কৃষক, শ্রমিক, তাঁতী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি তো আছেই।

বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে গ্রামের উদ্যমী যুবক নুরুল ইসলাম, নূর আলম শেখ, শহিদুল ইসলাম ও আব্দুল শেখকে। তাদের ভাবনাকে সমর্থন জানিয়ে এগিয়ে আসে করোনার কারণে বাড়িতে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আনিসুর রহমান। পরে তাদের এই উদ্যোগের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে পুরো গ্রামবাসী। সাঁকোটি নির্মাণে আর্থিকভাবে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা ও দিক-নির্দেশকের ভূমিকায় ছিলেন স্থানীয় সমাজসেবক নুরুল ইসলাম পারভেজ।

এ বিষয়ে সাঁকোটির অন্যতম উদ্যোক্তা আনিসুর রহমান বলেন, গ্রামবাসীর মতামত নিয়ে গত এপ্রিল মাসের শুরুতেই কাজ শুরু করা হয়। ৭০টি পরিবারের কাছ থেকে নেয়া হয় ৩০০ টাকা করে চাঁদা। স্থানীয় যুবক নুরুল ইসলাম দেন ৫ হাজার টাকা। এ নিয়ে উদ্যমী ৬ যুবক আর গ্রামবাসী মিলে কাজ শুরু করেন। এক হাজারেরও অধিক বাঁশ, ৮৫ সিএফটি কাঠ, দুই মণ ১৫ কেজি রশি, এক মণ ২৫ কেজি তারকাঁটা ও ৪০০ জন শ্রমিক নিয়ে নির্মিত সাঁকোটিতে খরচ হয়েছে তিন লক্ষাধিক টাকা। এ জন্য গ্রামবাসীসহ বিভিন্ন উৎস থেকে দুই লক্ষাধিক টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব হলেও নির্মাণ সামগ্রী ক্রয়ে বাকি রাখা, ঋণ গ্রহণ এবং ছোট খাটো মেরামত বাবদ আরও এক লক্ষ ৮ হাজার টাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের পক্ষে কোনোভাবেই এই টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

sirajgonj03.jpg

এলাকার মুরব্বি মো. আব্দুল্লাহ শেখ ও শহিদুল ইসলাম বলেন, সাঁকো নির্মাণ করতে গ্রামে বসবাসকারী প্রতিটি বাড়ি থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা নেয়া হয়েছে। সমাজসেবক নুরুল ইসলাম পারভেজসহ এলাকার বেশ কয়েকজন ব্যক্তির কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নেয়া হয়েছে। সাঁকোটি নির্মাণে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকায় ব্যয় করা হয়েছে। দীর্ঘতম বাঁশের সাঁকোটি নির্মাণে বিভিন্ন উৎস থেকে গৃহীত ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন উদ্যোক্তারা। তাদের এ ঋণ পরিশোধে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

ভবিষতে সাঁকোর স্থলে রাস্তা বা সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে মো. নুরুল ইসলাম পারভেজ বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সারাদেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। কিন্তু রাণীপুরা গ্রামের মানুষ এখনও সে উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত। তাই আমাদের এলাকার হাজার হাজার মানুষের কথা বিবেচনা করে দ্রুত একটি রাস্তা বা সেতু নির্মাণ করে এলাকাবাসীর কষ্ট লাগব করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

বেলকুচি সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোলেমান হোসেন বলেন, গ্রামবাসীর উদ্যোগে সাঁকোটি নির্মাণ করা হয়েছে। কিছু টাকা ঋণও আছেন উদ্যোক্তারা। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে। বিশেষ ক্ষেত্রে সেখানে একটি সেতু বরাদ্দের জন্য উপজেলার মাসিক আলোচনা সভায় বিষয়টি জোরালোভাবে উত্থাপন করা হয়েছে।

বেলকুচি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সাজেদুল বলেন, গ্রামবাসীর উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। চরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের জন্য একটি বৃহৎ সাঁকো তৈরি করেছে গ্রামবাসী। পণ্য পরিবহনের জন্য এখানে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি সেতু প্রয়োজন। আড়াইশ থেকে তিনশ মিটার প্রশস্ত হওয়ায় সেতুটি উপজেলা পরিষদ থেকে করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের পর্যাপ্ত বাজেটও নেই। সেতুটি একনেকে পাস করতে হবে। এজন্য উপজেলা প্রকৌশল অধিদফতর থেকে একটি প্রকল্প তৈরি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে দ্রুত নির্মাণ কাজ শুরু হবে।

বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, নদীঘেঁষা ওই গ্রামের অধিকাংশ জায়গা বর্ষায় পানিতে ডুবে গেলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। গ্রামবাসীর অর্থায়নে নির্মিত সাঁকো দিয়ে সদর ইউনিয়নের রাণীপুরা, দেলুয়া, মনতলা, বেলকুচির চর, মুলকান্দী, কালাই, আফজালপুর, হাট বয়ড়া, ছোট বেড়া, খারুয়া, দশখাদাসহ বিভিন্ন গ্রামের হাজারও মানুষ যাতায়াত করে। এখানে একটি সড়কসহ প্রায় তিনশ মিটারের মতো সেতু দরকার। এ জন্য উপজেলার মাসিক মিটিংয়ে আলোচনা করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে দ্রুত তা বাস্তবায়ন করা হবে।

তিনি আরও বলেন, সাঁকো নির্মাণে উদ্যোক্তাদের উপজেলা পরিষদ থেকে ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।

ইউসুফ দেওয়ান রাজু/আরএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।