কুড়িগ্রামে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রোগী দেখছেন পরিচ্ছন্ন কর্মী

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি কুড়িগ্রাম
প্রকাশিত: ০৫:২৯ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০

কুড়িগ্রামে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে পরিচ্ছন্ন কর্মী দ্বারা চলছে চিকিৎসা সেবা। মাঝে মধ্যে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেই চলে যান দায়িত্বপ্রাপ্তরা। আর দেখভালের অভাবে নিয়মিত খোলা হয় না জেলার প্রত্যন্ত এলাকার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলো। ফলে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে সরকারের।

সরেজমিনে দেখা যায়, নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লভের খাস ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে মিনা রাণী নামে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারী ঝাড়ু দেয়ার কাজ করছেন। পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষ করেই তিনি চিকিৎসাসেবা প্রদানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। প্রেসক্রিপশন দিতে না পারলেও রোগীর সমস্যা শুনেই চিকিৎসা দেন তিনি। বেশ কিছু ওষুধের নামও মুখস্থ তার। এখানে গেল তিন বছর ধরে তিনি পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে মাত্র ৫শ টাকায় কাজ করেন।

জানা গেল ডাক্তার ডেপুটেশনে অন্যত্র সুবিধা ভোগ করছেন। উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার, ফার্মাসিস্ট থাকলেও তারা নিয়মিত নন। ফলে মিনা রাণীই রোগীদের চিকিৎসা দেন। তারা মাঝে মধ্যে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেই চলে যান। দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলায় বল্লভের খাস ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

পরিচ্ছন্ন কর্মী মিনা রাণী জানান, তিন বছর ধরে তিনি এখানে কাজ করছেন। রোগীর চাপ থাকলে ডাক্তারকে সহযোগিতা করেন। মাঝে মধ্যে ডাক্তার না আসলে রোগীর ওষুধ দিয়ে থাকেন।

kurigram02.jpg

একই উপজেলার জনবল না থাকায় মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন নারায়ণপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা রাজ্জাক বলেন, কয়েক বছর আগে সপ্তাহে একদিন করে খোলা হতো এই স্বাস্থ্য কেন্দ্র। কিন্তু দীর্ঘদিন এটা আর খোলা হয় না। ফলে এই এলাকার মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত।

কেদার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, তালাবদ্ধ ভবন। জানালার গ্লাস ভাঙা। ভেতরে কক্ষে রোগীদের জন্য দেয়া বেড ধুলাবালিতে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। অবহেলা আর অযত্নে মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সরকারের দেয়া কোটি টাকার সরঞ্জামাদি।

ভূরুঙ্গামারী উপজেলার শিলখুড়ি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সামনের জায়গা দখল করে দোকান ঘর তৈরি করা হয়েছে। সেখানে শুধুমাত্র চলাচলের জায়গা রয়েছে। সরকারি ছুটি ছাড়া প্রতিদিন খোলার নিয়ম থাকলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিনামূল্যে ২২ প্রকার ওষুধ এই স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে দেয়ার কথা থাকলেও রোগীদের না দিয়ে নিয়মিত বিতরণ দেখিয়ে তা বাইরে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। সরকারি চিকিৎসা সেবা হতে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বাইরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন দারিদ্র্যপীড়িত এই জনপদের মানুষ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার সিংহভাগ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোর করুণ অবস্থা।

বল্লভেরখাস ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আকমল হোসেন জানান, স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকলেও চালু না থাকায় তার ইউনিয়নে চরাঞ্চলসহ গ্রামীণ জনপদের মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তার ইউপি ভবন না থাকায় স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দোতলায় পরিষদের কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

শিলখুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইসমাঈল হোসেন ইউসুফ বলেন, বহুবার কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারা কর্ণপাত করেনি। সীমান্ত আর নদী ভাঙন প্রবণ এলাকার গরিব মানুষ সরকারের স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছে।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ৮ উপজেলায় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে ৫৮টি। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের অধীনে ৪০টি এবং জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে রুলার ডিসপেনসারি (আরডি) ১৮টি।

সেগুলো হচ্ছে- সদর উপজেলার পাঁচগাছি। উলিপুরের দলদলিয়া, দুর্গাপুর ও পান্ডুল। ভূরুঙ্গামারীর শিলখুড়ি, বলদিয়া, চরভূরুঙ্গামারী ও বঙ্গসোনাহাট। নাগেশ্বরীর সন্তোষপুর, ভিতরবন্দ, কেদার ও বল্লভের খাস। রাজারহাটে ছিনাই, বিদ্যানন্দ, উমর মজিদ ও নাজিম খাঁ। চিলমারীর রমনা এবং রৌমারীর যাদুরচর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র।

মেডিকেল অফিসার পদ ৩৫টির মধ্যে শূন্য ২১টি। উপ-সহকারী ৪০টি পদের মধ্যে শূন্য ১১টি। ফুলবাড়ির বড়ভিটা, ভাঙ্গামোড় ও কাশিপুর। নাগেশ্বরীর নারায়ণপুর, নুনখাওয়া ও কালিগঞ্জ। চিলমারীর নয়ারহাট। রৌমারীর চরশৌলমারী ও শৌলমারী। ভূরুঙ্গামারীর তিলাই এবং পাথরডুবি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে পদ শূন্য রয়েছে।

নদী ভাঙনে ইতোপূর্বে বিলীন হয়েছে চিলমারী অষ্টমীর চর, রমনা এবং রাজিবপুরের মোহনগঞ্জ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র।

ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র দুই বিভাগের অধীনে থাকায় এসব অনিয়মের দায় এককভাবে নিতে রাজি নন জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, জনবল সঙ্কট এবং করোনাভাইরাসের কারণে চিকিৎসাসেবা প্রদান কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। দ্রুত এসব সমস্যা কেটে যাবে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

নাজমুল হোসাইন/আরএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।