ভাঙনে ছোট হচ্ছে কুড়িগ্রামের মানচিত্র
অডিও শুনুন
সারাবছরই নদ-নদীর তীব্র ভাঙনে দেশের বৃহত্তম নদ-নদীময় কুড়িগ্রাম জেলা এখন হুমকির মুখে। দিন যতই যাচ্ছে নদ-নদীর ভাঙনে ছোট হয়ে আসছে জেলার মানচিত্র। আর এতে করে গৃহহীন হয়ে পড়ছে হাজারো পরিবার। সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার পাশাপাশি কর্মহীন হয়ে পড়ছে মানুষ। তাই ভাঙন রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার দাবি কুড়িগ্রামবাসীর।
জেলার সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর পার্বতিপুরের ফারাজী পাড়ার বাসিন্দা সাবেক মেম্বার সাদের আলী পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে পাওয়া শত বিঘা জমি এখন ব্রহ্মপুত্র নদের পেটে। সব হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি। নদীর তীরেই পরিবার নিয়ে মাত্র ১২শতক জমিতে টিনের চালায় কাটছে দিন। হুমকির মুখে সেটুকুও।
এমন অবস্থা একই এলাকার জব্বার আলীরও। বাপ-দাদার ভিটে মাটিসহ শত বিঘার উপর সম্পত্তি প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে বিলীন হয়েছে মাত্র ৪-৫ বছর আগে। খেয়ে না খেয়ে এখন মানবেতর দিন কাটছে তারও।
এক সময় স্বচ্ছল আর সম্পদশালী থাকলেও এখন অভাব অনটনে দিন কাটছে তাদের মতো হাজারো পরিবারের। নদ-নদীর ভাঙনে এমন হাজারো পরিবার প্রতিবছর নিঃস্ব হচ্ছে। হয়ে পড়ছে গৃহহীন আর বেকার। দেশের বৃহত্তম নদ-নদীময় জেলা হলেও নদী শাসন কিংবা ভাঙন রোধে নেই কার্যকরী ব্যবস্থা। ফলে প্রতিবছর ভাঙনে নদীগর্ভে চলে যায় হাজার হেক্টর আবাদি জমি, বসত ভিটাসহ গাছপালা, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্থাপনা। এতে করে বেড়েই চলেছে গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৬টি নদ-নদীর ৩১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে কুড়িগ্রামের ৯টি উপজেলায় ৩টি পৌরসভা এবং ৭৩টি ইউনিয়ন রয়েছে। এরমধ্যে ৫৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা ভাঙনের শিকার হয়েছে। আর শতভাগ ভাঙন কবলিত ২টি উপজেলা চিলমারী এবং রাজিবপুর। জেলার মূল ভূ-খণ্ড থেকে পুরোপুরি বিছিন্ন ৮টি ইউনিয়ন। প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাধিক চরাঞ্চলে ৫/৭ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁঠালবাড়ী, হলোখানা, পাঁচগাছি, যাত্রাপুর, মোগলবাসা, ঘোগাদহ ও ভোগডাঙ্গা পৌরসভা।
নাগেশ্বরী উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার মধ্যে রায়গঞ্জ, বামনডাঙ্গা, কেদার, কালিগঞ্জ,বল্লভেরখাষ, কচাকাটা, নারায়ণপুর,বেরুবাড়ি, নুনখাওয়া ইউনিয়ন দুধকুমার, গংগাধর এবং ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের শিকার।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে দুধকুমার নদের ভাঙনে শিলখুড়ি, তিলাই, বলদিয়া, চরভূরুঙ্গামারী, পাইকারছড়া,বঙ্গসোনাহাট, আন্ধারীঝাড় ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
উলিপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার মধ্যে ধরলা, তিস্তা এবং ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের কবলে হাতিয়া, বুড়াবুড়ি, তবকপুর, বজরা, থেতরাই, গুনাইগাছ, বেগমগঞ্জ,সাহেবের আলগা।
ফুলবাড়ির ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ধরলা নদীর ভাঙনের কবলে নাওডাঙ্গা, শিমুলবাড়ী, ফুলবাড়ী সদর, বড়ভিটা ও ভাংগামোড় রয়েছে।
রৌমারী উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ, জিঞ্জিরাম নদীর ভাঙনের মুখে বিলীন হচ্ছে বন্দবের, রৌমারী সদর, যাদুরচর, চর শৌলমারী ইউনিয়ন।
রাজিবপুর উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন কোদালকাটি, মোহনগঞ্জ ও রাজিবপুর সদর ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত।
চিলমারী উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের অষ্টমির চর, নয়ারহাট, চিলমারী সদর, থানাহাট, রমনা এবং রাণীগঞ্জ ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র এবং তিস্তা নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রাজারহাট উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে তিস্তা ও ধরলা নদীর ভাঙনের শিকার ঘড়িয়াল ডাঙা, ছিনাই, বিদ্যানন্দ ও নাজিম খাঁ ইউনিয়ন।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, নদী ভিত্তিক পরিকল্পনা করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে জেলাকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে তিস্তা নদীর ১৬০ কিলোমিটার সংস্কার ও বাঁধ নির্মাণে ৮ হাজার ২শ কোটি টাকা এবং দুধকুমার নদীর ২৫কিলোমিটার সংস্কার ও বাঁধ নির্মাণে ৭১৪ কোটি টাকার প্রকল্প পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম জানান, চলতি বছরের বন্যা আর নদী ভাঙনে প্রায় সহস্রাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। গৃহহীন পরিবারের জন্য টিনসহ নগদ অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও এবারের বন্যায় ভাঙন কবলিত ৩২টি পয়েন্ট চিহ্নিত করে মেরামত করা হচ্ছে।
নাজমুল হোসেন/এফএ/জেআইএম