৪৮ বছর পর ‘দরজাবিহীন’ তৃপ্তি হোটেলে লাগানো হলো শাটার

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি পাবনা
প্রকাশিত: ০৬:০২ পিএম, ২৫ আগস্ট ২০২০

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার অন্যতম প্রধান খাবার হোটেল হিসেবে পরিচিত ‘তৃপ্তি হোটেল’। ঈশ্বরদী শহরে এসে তৃপ্তি হোটেলে সকাল, দুপুর কিংবা রাতের খাবার খাননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই হোটেলের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর কোনো দরজা ছিল না। ঈদের ছুটির তিনদিন ছাড়া সারা বছর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকতো হোটেলটি। প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছর পর হোটেলটিতে শাটার লাগানো হয়েছে।

দেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি আমলা, এমপি, মন্ত্রী, পদস্থ কর্মকর্তাদের পদচারণা রয়েছে এই তৃপ্তি হোটেলে। বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে ‘দরজাবিহীন’ এই হোটেল নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারসহ একাধিক জাতীয় সংবাদপত্রেও এই হোটেল নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। বিবিসি বাংলায় এই হোটেল নিয়ে নিউজ প্রকাশ হয়েছে। এমনকি ভারতের বিখ্যাত ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলি দাদাগিরিতে প্রশ্ন করেছিলেন বাংলাদেশের কোন জেলার কোন উপজেলায় দড়জাবিহীন হোটেল রয়েছে। রাশিয়া, চীন, ভারত, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের অসংখ্য নাগরিক এই হোটেলের খাবার খেয়ে প্রশংসা করেছেন।

স্থানীয়রা বলেন, হোটেলটি ঈশ্বরদী জংশনের পাশে হওয়ায় সকাল-বিকেল কিংবা সন্ধ্যায় বেড়াতে এসে প্রতিদিন একবার হলেও তৃপ্তি হোটেলে নাস্তা করে আমরা মনের তৃপ্তি পূরণ করি। এই হোটেলের বিশেষত্ব হলো গরুর ভাজা মাংস। এটা খুবই মজাদার।

স্থানীয় ব্যবসায়ী মিঠু মিয়া বলেন, হোটেলের পাশেই আমার ব্যাগের দোকান। প্রতিদিনই আমি এখানে খাবার খেতে আসি। মানসম্মত খাবার ও হোটেলের পরিবেশ ভালো হওয়ায় ঈশ্বরদীবাসীর কাছে প্রিয় তৃপ্তি হোটেল।

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে হোটেলে খেতে আসা সুমন আহমেদ বলেন, ‘আমি ঈশ্বরদী শহরে সপ্তাহে দুদিন ব্যক্তিগত কাজে আসি। নাস্তা ও খাবার সবই এই হোটেলে করি। কারণ এই হোটেল যত রাতেই আসি খোলা থাকে, খাবার পাওয়া যায়। বর্তমানে শাটার লাগানোর কারণে গভীর রাত হলে এই হোটেলে আর আসা হয় না। স্থানীয় কিছু বখাটের আড্ডার কারণে হোটেলে শাটার লাগানো হয়েছে। এটা কষ্টদায়ক।’

৩৭ বছর ধরে তৃপ্তি হোটেলে কর্মরত আব্দুল খালেক বলেন, ‘আমি এখন কোনো কাজ করতে পারি না। কাজে অক্ষম, অনেকটাই প্যারালাইসিসের মতো হয়ে আছি। তবুও হোটেল মালিক আমাকে রেখে দিয়েছেন। বেতন-ভাতাসহ নানা সুবিধাও পাই। এখান থেকে কোনো কর্মচারী চাকরিচ্যুত হয় না।’

তিনি আরও বলেন, ৩৭ বছর ধরে দেখছি সব পেশার মানুষ এখানে খাবার খেতে আসে। শহরে যত রাজনৈতিক-সামাজিক সভা হয়, সেখানে আগত অতিথিদের আপ্যায়ন করানোর প্রধান জায়গা এই তৃপ্তি হোটেল।

হোটেলের ম্যানেজার বিপ্লব কুমার বলেন, ১৯৮৯ সালে শৈশবকালে এই হোটেলে কাজে আসি। দীর্ঘ বছর দেখেছি এপার বাংলা ওপার বাংলার কবি সাহিত্যিকদের পদচারণায় মুখরিত ছিল এই হোটেল। হোটেলের সামনে বিশাল রেডিও লাগানো ছিল। এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ বিবিসির খবর শোনার জন্য এখানে ভিড় করতো। প্রয়াত সাংবাদিক কামাল লোহানী, প্রয়াত সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুসহ দেশের কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলায় পরিণত হতো এই হোটেল। বিকেল থেকে সন্ধ্যা এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত চলতো আড্ডা।

জানা গেছে, ১৯৭২ সালে হোটেলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই দিন-রাত সমানে চলেছে। একদিনের জন্যও হোটেলটি কেউ বন্ধ পায়নি। হোটেলটি মূলত রেলওয়ের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। জায়গাটির লিজ গ্রহীতা আবদুর রহিম। এখনও হোটেলের সাইনবোর্ডে তার নাম লেখা। পরবর্তী সময়ে আবদুর রহিম ঘরটি ভাড়া দেন স্থানীয় ডোমনাকে। এখন বংশ পরম্পরায় এই হোটেলের বর্তমান সব দায়িত্ব ও পরিচালক আব্দুল মালেক মানিক।

বর্তমান হোটেলটিতে ২০ জন কর্মচারী ও দুজন ম্যানেজারসহ প্রায় ২৫ জন কর্মচারী নিয়োজিত আছেন। আগে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকলেও বর্তমান করোনাভাইরাসের কারণে হোটেলটি ভোর ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ১৬ ঘণ্টা খোলা থাকে।

ঈশ্বরদী প্রেস ক্লাবের সভাপতি স্বপন কুমার কুন্ডু বলেন, ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর এই হোটেল ছিল এপার বাংলা ওপার বাংলার কবি সাহিত্যিকদের মিলনমেলা। এশিয়ার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হোটেল এটি। হোটেলটি রেলওয়ে জংশনের পাশে হওয়ায় সব সময় ভিড় জমে থাকতো। খাবার খেতে সিরিয়াল দেয়া লাগতো। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে হোটেলের বেচা-কেনা অনেকটাই কম। এই কারণে মালিকপক্ষ ২৪ ঘণ্টা হোটেল খোলা রাখার পরিবর্তে মাত্র ১৬ ঘণ্টা খোলা রাখে।

তিনি বলেন, একটা সময় এই তৃপ্তি হোটেল ছিল সাংবাদিকদের আড্ডা ও খাবারের জায়গা। সময়ের পরিবর্তনে এখন সেই নিয়মিত আড্ডা না হলেও প্রায়ই এখানে আড্ডা দিতে আসি। এই হোটেলে দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবীদের আনাগোনা ছিল।

হোটেলের বর্তমান পরিচালক আব্দুল মালেক মানিক জানান, প্রয়াত আবদুর রহিমের পর হুমায়ুন কবির ও মহব্বত আলী এই হোটেলটির হাল ধরেন। এরপর মহব্বত আলীর ছোট ভাই ইদ্রিস আলী হোটেলটি পরিচালনার দায়িত্ব পান। হোটেল পরিচালনায় ছিলেন তার ছোট ভাই আমজাদ হোসেন ডোমনা। বংশ পরম্পরায় বর্তমানে হোটেলটি পরিচালনা করেন ইদ্রিস আলীর দুই ছেলে আব্দুল মান্নান ও আব্দুল মালেক মানিক।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের শুরুতে যখন প্রশাসন হোটেলটি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় তখন বন্ধ হোটেলটিতে স্থানীয় বখাটের দল রাতভর আড্ডা দিয়ে স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছিল। বাধ্য হয়ে হোটেলটি রক্ষার স্বার্থে প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছর পর শাটার লাগাতে বাধ্য হই। শাটার লাগানোর মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যময় এই হোটেলটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেল।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, দরজাবিহীন হোটেলটির ঐতিহ্য আর ধরে রাখা গেল না। এখন থেকে আর বলার সুযোগ রইল না যে এই হোটেলের দরজা নেই।

আরএআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।