২৫ বছর পর ইয়াসমিনের মা বললেন ‘কেউ কথা রাখেনি’
আজ ২৪ আগস্ট। ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস। ১৯৯৫ সালের এই দিনে কতিপয় বিপথগামী পুলিশ সদস্য কর্তৃক ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন কিশোরী ইয়াসমিন। এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের মানুষ। বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় সাজন। সেদিন থেকেই সারাদেশে এই দিবসটি পালিত হচ্ছে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে।
১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট ভোরে ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী হাছনা এন্টারপ্রাইজ নৈশকোচের সুপারভাইজার ইয়াসমিন নামে এক তরুণীকে দিনাজপুরের দশমাইল মোড়ে নামিয়ে দেয় এবং একটি চায়ের দোকানদারকে বলে সকাল হলে তরুণীকে যেন দিনাজপুর শহরগামী বাসে উঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সেখানে পৌঁছে নৈশ টহল পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান। পুলিশ সদস্যরা চায়ের দোকানে বেঞ্চে বসে থাকা তরুণী ইয়াসমিনকে নানা প্রশ্ন করে। একপর্যায়ে দিনাজপুর শহরে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে জোরপূর্বক পুলিশ ভ্যানে তুলে নেয়। এরপর তারা দশমাইল সংলগ্ন সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ রাস্তার পাশে ফেলে রেখে চলে যায়।
এ ঘটনায় দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে দোষীদের শাস্তির দাবি করা হয়। ২৬ আগস্ট রাতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী কোতোয়ালি থানা ঘেরাও করেন। ২৭ আগস্ট সকাল থেকে প্রতিবাদী মানুষ শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। দুপুর ১২টার দিকে কয়েক হাজার জনতা বিক্ষোভ মিছিল সহকারে দোষীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দেন। এ সময় পুলিশ বিনা উসকানিতে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে সামু ,কাদের, সিরাজসহ সাতজনকে হত্যা করে। আহত হন তিন শতাধিক মানুষ।
শহরের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শহরে নামানো হয় বিডিআর। দিনাজপুর থেকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ ১৩ উপজেলার সব পুলিশ একযোগে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
মেয়ে হত্যার ২৫ বছরে এসে ইয়াসমিনের মা ফরিদা বেগম বললেন, বিএনপি আওয়ামী লীগ কেউ কথা রাখেনি। এখন আর কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন কিংবা কোনো এনজিও তার খবর নেয় না। কোনো অনুষ্ঠানে তাকে ডাকা হয় না। অথচ ইয়াসমিন ধর্ষণ হত্যা এবং ঘটনার প্রতিবাদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অনেকে অনেকভাবে সুবিধা নিয়েছেন। ১০-১২ বছর ধরে এই দিবসটিও আর তেমনভাবে কেউ পালন করে না। এবার তো করোনার কারণে কোনো কর্মসূচির খবর এখনও পাওয়াই যায়নি।
দুপুর আড়াইটায় দিনাজপুর শহরের গোলাপবাগ লেবুর মোড়ে ইয়াসমিনের মায়ের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় তিনি বাড়িঘর পানি দিয়ে পরিষ্কার করছেন। মেয়ের ২৫তম মৃত্যুবাষির্কী উপলক্ষে দোয়া খায়েরের আয়োজন করেছেন তিনি।
সাংবাদিক হিসেবে আগে থেকেই পরিচয় থাকায় এ প্রতিবেদককে দেখেই মেয়ের ছবি হাতে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করের তিনি। মেয়ের ছবিতে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন কেউ কথা রাখেনি। বিএনপি আওয়ামী লীগ কিংবা কোন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠন আমার খবর নেয় না।
তিনি বলেন, আমার বর্তমান স্বামী কয়েল বিক্রি করে সংসার চালায়। আমার একটি ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। সংসারে অভাব অনটন লেগেই আছে।
তিনি আরও বলেন, আমার তো আর চাকরির বয়স নেই। এখন ইচ্ছা করলেও সরকার আমাকে চাকরি দিতে পারবে না। এখন যদি সরকার একটা জমি বন্দোবস্ত করে ছাগল কিংবা মুরগির খামার করে দিত, তাহলে স্বামী সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাতে পারতাম।
তিনি বলেন, আমার মেয়ের ধর্ষক পুলিশদের ফাঁসি হলেও সে সময় যারা বিচারের দাবিতে গুলি খেয়ে মারা গেছে এবং আহত হয়েছে তারা এখনও বিচার পায়নি। আমার মেয়ে ধর্ষণ এবং হত্যার যেমন বিচার হয়েছে, তেমনি যারা আমার মেয়ের জন্য জীবন দিয়েছে তাদের হত্যাকারীদেরও বিচার চাই।
তিনি বলেন, সে সময়ের জেলা প্রশাসক এটিএম জব্বার ফারুক ও পুলিশ সুপার মোতালেব হোসেনের সাজা হলে আরও খুশি হতে পারতাম।
ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় দায়ের মামলাটি ৩টি আদালতে ১২৩ দিন বিচারকাজ শেষে ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মতিন মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার রায়ে আসামি পুলিশের এএসআই মঈনুল, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পুলিশের পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান ‘৯৫-এর ৬ (৪) ধারায় ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেয়া হয়। আলামত নষ্ট, সত্য গোপন ও অসহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এএসআই মঈনুলকে আরও ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
অপরদিকে অভিযুক্ত আসামি দিনাজপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেব, ডা. মহসীন, এসআই মাহতাব, এসআই স্বপন চক্রবর্তী, এএসআই মতিয়ার ও এসআই জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২০১/৩৪ ধারায় আলামত নষ্ট, সত্য গোপন, অসহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের খালাস দেন।
চাঞ্চল্যকর ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় ৮ বছর পর অর্থাৎ ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে মামলার অন্যতম আসামি এএসআই মঈনুল হক ও কনস্টেবল আব্দুস সাত্তারকে রংপুর জেলা কারাগারের অভ্যন্তরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। অপর আসামি পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মনকে রংপুর জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয় ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে।
এ ব্যাপারে কথা হয় ইয়াসমিন আন্দোলনের প্রথম প্রতিবাদকারী ও আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বর্তমানে দিনাজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপালের সঙ্গে। তিনি বলেন, সে সময়ের গণঅভ্যূথ্থান অন্ততপক্ষে সমগ্র বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিল মর্যাদা রক্ষার জন্য দিনাজপুর পারে এবং মর্যাদা রক্ষায় দিনাজপুরের মানুষ সর্বচ্চো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।
তিনি বলেন, এটা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের আন্দোলন ছিল না। এ আন্দোলন সমগ্র দিনাজপুরবাসীর আন্দোলনে রূপ নেয়। যার কারণে তদানিন্তন বিএনপি জামায়াত জোট সরকার বাধ্য হয়েছিল জনতার দাবি মেনে নিতে। যদিও তারা দাবিগুলো বাস্তবায়ন করেনি। ৮ দফা দাবি মেনে নিয়ে তৎকালীন সরকার প্রধানের বিশেষ প্রতিনিধি এসে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়।
আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সরকারের কী ভূমিকা ছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিএনপি-জামাত জোট সরকার কথা দিয়ে কথা রাখেনি। তারা ৮ দফার ভিত্তিতে সমঝোতা করলেও একটি শর্তও তারা পূরণ করেনি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে দাবিগুলো পূরণ করেছে এবং দোষীদের বিচার করেছে।
তিনি বলেন, আমাদের কিছু অর্জন রয়েছে কিন্তু আমরা এখনও ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহতদের পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করতে পারিনি। ইয়াসমীন এখন সারা বিশ্বে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের একটি প্রতীক।
এমদাদুল হক মিলন/এফএ/এমএস