ভেঙে গেছে বাঁধ, পানিতে ভাসছে সাতক্ষীরা উপকূল
একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে দিশেহারা সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দারা। আইলা থেকে শুরু করে সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে বিধ্বস্ত উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ। তবে এবার সেই বাঁধগুলো ভাঙছে নদীর প্রবল জোয়ারের পানিতে। জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায় উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। পানিতে ভাসছে গোটা এলাকা। দেখা দিয়েছে চরম মানবিক বিপর্যয়।
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের লেবুগুনিয়া এলাকায় জোয়ারের তোড়ে ভেঙেছে কপোতাক্ষ নদের বাঁধ। প্লাবিত হয়েছে ছয়টি গ্রাম। সেখানে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে পাঁচ হাজার মানুষ।
অন্যদিকে আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা, প্রতাপনগর ও আশাশুনি সদরের খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদের বাঁধ ভেঙে অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। মৃতদের সৎকার ও দাফন করা হচ্ছে অন্যত্র নিয়ে।
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল ইসলাম জানান, লেবুগুনিয়া ও গাবুরা গ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকায় কপোতাক্ষ নদের ক্লোজার বাঁধ ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০ হাজার বস্তা দিয়েছে। জনগণ নিয়ে সেই বস্তায় মাটি ভর্তি করে বাঁধ সংস্কার কাজ শুরু করবো। আইলার সময় এখানে ক্লোজার ছিল। সেটি ভেঙে গেছে। আম্ফানের পর তিন কিলোমিটার রিং বাঁধ করেছি সেটিরও কিছু অংশ জোয়ারের কারণে ভেঙেছিল, তবে সংস্কার করেছি। জোয়ারের পানিতে যেখানে কখনও ভাঙেনি, সেখানেও ভাঙল এবার। ইউনিয়নের লেবুগুনিয়া, চকবারা, গাবুরা, খোলপেটুয়া, খলশিবুনিয়া ও লক্ষ্মীখালী গ্রাম ডুবে গেছে। এসব গ্রামের পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হেনা সাকিল জানান, ইউনিয়নের হাজরাখালী এলাকার খোলপেটুয়া নদীর ভাঙা বাঁধ দিয়ে এলাকায় পানি প্রবেশ করে ইউনিয়নের ২২টি গ্রামই প্লাবিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তাণ্ডবে হাজরাখালী এলাকায় ৫০০ ফুট বাঁধ ভেঙে যায়। সেই বাঁধটি আজও সংস্কার করা হয়নি। পরে সেনাবাহিনীকে বাঁধটি সংস্কারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী এখনও কাজ শুরু করেনি।
তিনি জানান, গত তিনদিনে ইউনিয়নের চারজন মুসলিম ও একজন সনাতন ধর্মের মানুষ মারা গেছেন। মুসলিমদের সাতক্ষীরা সদর ও শ্যামনগর উপজেলায় নিয়ে দাফন করা হয়েছে। আর সনাতন ধর্মের মানুষকে উঁচু একটি রাস্তায় নিয়ে সৎকার করা হয়েছে। মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে রয়েছে। মারা গেলে দাফন ও সৎকারের জায়গাটুকুও নেই। আম্ফানের পর কিছু কাঁচা ঘরবাড়ি ভালো ছিল, তার একটিও এখন নেই। ইউনিয়নের ৩৫ হাজার মানুষই চরম দুর্ভোগে রয়েছে। বাঁধ সংস্কারে এখনও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন জানান, প্রতাপনগর ইউনিয়নে কপোতাক্ষের বাঁধ ভেঙে কুড়িকাওনিয়া, হিজলিয়া, কোলা, চাকলা, হরিশখালী এলাকার বাঁধ ভেঙে গোটা ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। ১৭টি গ্রামের ৩৩ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এখনও বাঁধ সংস্কারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে বাঁধ সংস্কারের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন।
আশাশুনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অসীম বরণ চক্রবর্তী জানান, আশাশুনি সদরে দয়ারঘাট জেলেখালী এলাকায় বাঁধ ভেঙে চারটি গ্রামের দুই হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তবে জেলেখালী এলাকার বাঁধটি রিং বাঁধ দিয়ে সংস্কার করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী (শ্যামনগর) আবুল খায়ের বলেন, গাবুরা এলাকায় যে ছয়টি পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে সেগুলো সংস্কার করা হয়েছে। বড় একটা অংশে ভাঙন রয়েছে। সেখানেও সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী (আশাশুনি) সুধাংশু কুমার সরকারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে রয়েছে। এসব এলাকায় উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধের জন্য সরকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সেটি একনেকে অনুমোদন হওয়ার পর কাজ শুরু হবে। বাঁধের কিছু অংশ সেনাবাহিনী ও কিছু অংশ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সংস্কারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে জানানো হয়েছে উপকূলে বাঁধ রক্ষায় যা যা করা দরকার তার সবটুকুই করা হবে। কাজটি দ্রুত শুরু হবে। তবে প্রাথমিকভাবে উপকূল দিয়ে যেন পানি প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য পানি ব্যবস্থা কমিটি, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করে সংস্কার কাজ শুরু করা হয়েছে। সেসব এলাকা দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে সেসব এলাকায় সংস্কার কাজ প্রাথমিকভাবে যেটুকু করা যায় সেটুকু তারা করবে। বাঁধের কিছু অংশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও কিছু অংশ সেনাবাহিনীর দায়িত্বে রয়েছে। সেনাবাহিনী এই মুহূর্তে কাজ করতে পারছে না। কারণ কাজের পরিবেশ নেই। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ কেউ করতে পারে না। এটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
জেলা প্রশাসক বলেন, ইতোমধ্যে দুর্গত এলাকায় ৯৫ মেট্রিক টন চাল ও আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী দুর্গত মানুষদের জন্য ২০০ মেট্রিক টন চাল ও দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। ত্রাণ বিতরণের কাজও চলমান রয়েছে। দুর্গতদের সবার মাঝে এসব ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হবে।
আকরামুল ইসলাম/আরএআর/এমকেএইচ