বর্ডার খোলার আকুতি জানিয়ে মেঘাশ্রীর কান্না
‘প্লিজ বর্ডারটা খুলে দাও। তোমরা এরকম করছো কেন। আমি বাবাকে অনেক ভালোবাসি। আমি বাবার কাছে যেতে চাই। বাবার জন্য আমার মায়া লাগছে। প্লিজ বর্ডারটা খুলে দাও।’
এভাবে কথাগুলো বলছিল মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে বেড়াতে এসে আটকা পড়া তিন বছরের শিশু মেঘাশ্রী মজুমদার। কথাগুলো বলার সময় বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার করুণ আকুতি তার চোখে মুখে ফুটে ওঠে। রাতদিন কান্নাকাটি করছে মেঘাশ্রী। বার বারই বলছে, সে কলকাতায় তার বাবার কাছে ফিরতে চায়। মেঘাশ্রী মজুমদার ভারতের কলকাতার শ্যামনগর এলাকার পলাশ মজুমদার ও প্রিয়াঙ্কা কর দম্পতির একমাত্র কন্যা।
মেঘাশ্রী মজুমদারের মা প্রিয়াঙ্কা কর জানান, বাংলাদেশে তাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন। বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় তার চাচার বাড়ি। চাচার ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল ১১ মার্চ। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ৮ মার্চ মেয়ে মেঘাশ্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেনাপোল বন্দর দিয়ে বরিশালের গৌরনদীতে আসেন। ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় মেঘাশ্রীর বাবা পলাশ মজুমদার আসতে পারেননি।
প্রিয়াঙ্কা কর বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে ১৩ মার্চ থেকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় নাগরিকদের দেশে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যায়। ভারতের স্থল বন্দরগুলি দিয়ে এখনও নিয়মিত মানুষ চলাচল শুরু হয়নি। ভারতে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।
প্রিয়াঙ্কা কর বলেন, গত সাড়ে পাঁচ মাস ধরে বাংলাদেশে আটকা রয়েছি। কতদিন আর আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বেড়ানো যায়। হাতে যা টাকা-পয়সা ছিল তা অনেক আগেই খরচ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে চলছি।
তিনি বলেন, মেয়েটির মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মেঘাশ্রী কখনও এতদিন বাবাকে ছাড়া থাকেনি। সে কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। তার প্রতীক্ষা শুধু, আবার কবে বাবার কাছে ফিরে যাবে। বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। সে বাবার কাছে ফিরতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ের মুখোমুখি আমরা। আর কতদিন যে এভাবে থাকতে হবে সেটাও জানি না।
প্রিয়াঙ্কা কর বলেন, সম্প্রতি বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন থেকে জানানো হয়েছে, চিকিৎসা, ব্যবসা বা ভ্রমণ যে কোনো কারণে উভয় দেশে যেতে হলে কয়েকটি শর্ত মানতে হবে। বৈধ পাসপোর্ট ও ২০২০ সালের ১ জুলাই ইস্যুকৃত ভিসা থাকতে হবে। সেই সঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনের অনুমতিপত্র। যাত্রীর সঙ্গে থাকতে হবে কোভিড-১৯-এর নেগেটিভ সার্টিফিকেট। সেই সার্টিফিকেট ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হতে হবে ও ভারতে প্রবেশ করতে হবে। তবেই ভারতে প্রবেশের ছাড়পত্র দেয়া হবে। প্রতিদিনই বাংলাদেশের ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের অফিসে ফোন দিয়ে যাচ্ছি। তারা একটা কথাই বলছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে আমাদের এ বিষয় কিছুই জানানো হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনুমতি না দিলে বাংলাদেশের ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের অফিস থেকে অনুমতিপত্র দেয়া সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, বরিশালের বিভিন্ন জেলায় আমার মতো অনেকে আটকা রয়েছেন। এরকম ১০ জনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে। বর্ডার বন্ধ থাকায় দেশে ফিরতে পারছেন না তারাও। টাকা-পয়সা ফুরিয়ে যাওয়ায় তাদের বেশির ভাগই এই মুহূর্তে বিপদে আছেন। বাংলাদেশে আটকে পড়া পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বেশি। বেশির ভাগ মানুষই বাংলাদেশে নিজেদের আত্মীয়দের দেখতে এসেছেন।
প্রিয়াঙ্কা কর জানান, পারিবারিক প্রয়োজন এবং অসুস্থতার মতো কারণ ছাড়া স্থল সীমান্ত দিয়ে এখনও ভারতে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। আবার ঢাকা থেকে বিমানে করে বাংলাদেশে আটকে পড়া ভারতীয়দের দেশে ফেরানোর যে ব্যবস্থা করেছিল দিল্লি, অর্থনৈতিক কারণে তারা সেই সুযোগও নিতে পারছেন না। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের প্রতি আকুল আবেদন যেকোনোভাবে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়া হোক।
এদিকে, মা-মাসিকে নিয়ে বেড়াতে এসে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় আটকা পড়েছেন ভারতের শিলিগুড়ি এলাকার যুবক পার্থ পাল চৌধুরী। এখন তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না।
পার্থ পাল চৌধুরী বলেন, মামার বাড়িতে গত ৮ মার্চ এসেছি। এখন আর দেশে ফিরতে পারছি না। বাবা অসুস্থ। বাড়িতে ফিরতে বলেছেন। তবে বর্ডার বন্ধ থাকায় ভারতে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
পার্থ পাল চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রায় ২০০ জন ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। বাংলাদেশের ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি আমরা। সেখান থেকে বলা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনুমতি না দিলে বাংলাদেশের ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের অফিস থেকে অনুমতিপত্র দেয়া সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে বরিশাল নগরীর কাশিপুর এলাকায় অবস্থিত ভারতীয় ভিসা আবেদন সেন্টারের ইনচার্জ সাব্বির হোসেন বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে ভিসা আবেদন সেন্টারটি কয়েক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। তবে ভারতের পাসপোর্টধারীরা দেশে ফিরতে বাংলাদেশের বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসগুলোতে যোগাযোগ করতে পারেন। সেখানে প্রথমে তাদের রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এরপর পাসপোর্ট অফিসগুলো থেকে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের অফিসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করা ব্যক্তিদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করবেন। যারা বাংলাদেশে আটকা পড়েছেন তারা এ প্রক্রিয়ায় চেষ্টা করবেন।
এএম/এমকেএইচ