টাঙ্গাইলে একসঙ্গে ১৮২ ভবন নির্মাণ নিয়ে রহস্য

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি টাঙ্গাইল
প্রকাশিত: ০৭:২৯ পিএম, ১৮ আগস্ট ২০২০

টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় নির্মাণাধীন দেড় শতাধিক একতলা ভবন নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে রাজধানীর উত্তরাস্থ কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি (কেজেআরসি) এসব ভবন নির্মাণ করে দিচ্ছে দাবি করা হলেও কেজেআরসি বিষয়টি অস্বীকার করেছে। এসব ভবনের অর্থায়ন ও নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষের গোপনীয়তায় স্থানীয় পর্যায়ে চলছে জঙ্গি তৎপরতার নানা আলোচনা-সমালোচনা।

সরেজমিনে দেখা যায়, কালিহাতী উপজেলায় একসঙ্গে ১৮২টি একতলা ভবন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে এলেঙ্গা পৌরসভায় ৫৩টি ভবন নির্মাণ হবে। এরই মধ্যে একসঙ্গে ১৭টি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। দোতলা ফাউন্ডেশনে ৩৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৮ ফুট প্রস্থের ছাদসহ একতলা ভবনে তিনটি বেডরুম, একটি রান্নাঘর, একটি ডাইনিং, দরজা-জানালা, মেঝে টাইলস সংবলিত ভবন নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে। কাজের জন্য তিন কিস্তিতে কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটিকে চার লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করবেন ভবন মালিক।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে মালিকদের কাছ থেকে ভবন নির্মাণ করে দেয়ার শর্তে ৬-৭ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। মালিকদের কাছ থেকে ওই টাকা কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি (কেজেআরসি) বগুড়ার প্রতিনিধি পরিচয়ে আব্দুর রউফ ও সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার প্রতিনিধি পরিচয়ে মাহবুব আলম গোপনে সংগ্রহ ও ভবন নির্মাণ করে দিচ্ছেন।

jagonews24

টাঙ্গাইলের উপশহর এলেঙ্গার টিনের দোকানের কর্মচারী মো. শরীফ খান, এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মুফতি সানোয়ার হোসাইন সাইফী, কালিহাতী উপজেলার সল্লা সমবায় উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাদেক আলী মোল্লা, এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের খান ট্রেডার্স দোকানের কর্মচারী দেলোয়ার হোসেন দুলাল স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে এলাকাবাসীর কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা করছেন।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, যাদের ভবন করে দেয়া হচ্ছে তারা সবাই আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। মুসলিম ব্যতীত কাউকে ভবন করে দেয়া হয় না। গোপনে টাকা নেয়া এবং আর্থিক স্বচ্ছতা না থাকা ব্যক্তিদেরও ভবন নির্মাণ করে দেয়ায় ‘জঙ্গি অর্থায়নের’ আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

এলেঙ্গা পৌরসভার মসিন্দা এলাকার শিপন সিকদার, শিল্পী মাস্টার, বিপ্লব সিকদার, দেলোয়ার হোসেন দুলাল, রাজাবাড়ী এলাকার বজলুর রহমান সরকার, সাদেক আলী মোল্লা, হায়াতপুর এলাকার হায়দার আলীসহ ১৭ জনের বাড়িতে ইতোমধ্যে একই ধরনের একতলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। তারা সবাই কিছু টাকা পরিশোধ করেছেন। এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তারা। প্রকল্পে জড়িত স্থানীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন তারা।

jagonews24

স্থানীয় প্রতিনিধি পরিচয়দানকারী মো. শরীফ খান, হাফেজ মাওলানা মুফতি সানোয়ার হোসাইন সাইফী, সাদেক আলী মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন দুলালের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়ার আব্দুর রউফ ও সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার মাহবুব আলমের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তারা।

বগুড়ার আব্দুর রউফ ও সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার মাহবুব আলম নিজেদের কেজেআরসির প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে বলেন, হতদরিদ্রদের পাকা ভবন নির্মাণ করে দেয়ার এ প্রকল্প কেজেআরসির। হতদরিদ্ররা সাড়ে চার লাখ টাকা দিতে না পারায় মধ্যবিত্তরাও এই সুযোগ পাচ্ছেন। সাড়ে চার লাখ টাকা করে নিয়ে ১৮২টি একতলা ভবন নির্মাণ করা হবে।

কালিহাতী উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, স্থানীয়রা ৫-৭ লাখ টাকা দিয়ে ১৫ লাখ টাকার একতলা ভবন পাচ্ছেন- এটা অবশ্যই সুখবর। কিন্তু ভবন নির্মাণ ও টাকা লেনদেনে গোপনীয়তা জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ভবন নির্মাণে অর্থের উৎস কী? এত বড় অনুদান দোকান কর্মচারীর মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে কেন? ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়াই বলে দিচ্ছে এখানে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা দরকার।

এলেঙ্গা পৌরসভার মেয়র নুর এ আলম সিদ্দিকী বলেন, একই মাপের একতলা ভবন নির্মাণের জন্য স্থানীয়দের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেশকিছু ভবনের প্ল্যান অনুমোদন দিয়েছি। আরও কিছু ভবন অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। শুনেছি এসব ভবন নির্মাণে অর্থায়ন করছে কেজেআরসি।

jagonews24

কেজেআরসি টাঙ্গাইলের প্রতিনিধি মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, সাধারণত মসজিদ নির্মাণে অর্থায়ন করি আমরা। কেজেআরসির বাংলাদেশের হেড অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবন নির্মাণের কোনো প্রকল্প গ্রহণ করেনি কেজেআরসি। কালিহাতী উপজেলায় একসঙ্গে ১৮২টি একতলা ভবন নির্মাণের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

টাঙ্গাইলের কালিহাতী সার্কেলের এএসপি রাসেল মনির বলেন, বিষয়টি জেনেছি। যারা ভবন নির্মাণে সম্পৃক্ত তাদের প্রতিনিধিদের ডেকে বিস্তারিত জানতে চেয়েছি। তবে তারা কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখানোর প্রতিশ্রুতি দেন তারা।

টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার (এসপি) সঞ্জিত কুমার রায় বলেন, একসঙ্গে এতগুলো ভবন নির্মাণের বিষয় আমাদের জানানো হয়নি। তবে বিষয়টি আমরা জেনেছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজখবর নেয়া হবে। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।

আরিফ উর রহমান টগর/এএম/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।