উঠে গেছে সড়কের পিচ-খোয়া-কার্পেটিং, প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর-ওয়ার্শী-বালিয়া আঞ্চলিক সড়কের উত্তর রোয়াইল সেতুর সংযোগ সড়ক ধসে পড়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে প্রথমে ফাটল ধরে এবং পরে সড়কটি ধসে পড়ে। এতে উপজেলা সদরের সঙ্গে দক্ষিণ মির্জাপুরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকা ও মানিকগঞ্জের সঙ্গে মির্জাপুরের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
১৯৭৪ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালীন অর্থমন্ত্রী ড. এর আর মল্লিক মির্জাপুর-ওয়ার্শী বালিয়া সড়কটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করায় সড়কটির নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সড়কটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সড়কটি নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেন। ২০১১ সাল থেকে সড়কটির নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ২০১৭ সালের জুন মাসে শেষ হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মির্জাপুর উপজেলা সদর থেকে ওয়ার্শী হয়ে মানিগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়া পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে মির্জাপুর অংশে ৯.১২ কিলোমিটার এবং মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার অংশে ২.৮৮ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। সড়কটির জন্য জমি অধিগ্রহণসহ নির্মাণব্যয় ধরা হয় প্রায় ১১১ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
এর ফলে উপজেলার দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তির অবসান হয়। সড়কটি চালু হওয়ার পর ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহনের চাপ অনেক কমে যায়। যানজট প্রবণ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বিকল্প সড়ক হিসেবে সড়কটি গুরুত্ব বহন করে। ঢাকা ও মানিকগঞ্জ সড়কের শত শত যানবাহন এই সড়ক দিয়ে চলাচল করে।
সড়কটি নির্মাণের জন্য টাঙ্গাইল ও ঢাকার কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব পায়। প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রায় ১৯ জন ঠিকাদার ১৩টি কালভার্ট, পাঁচটি সেতু ও মাটি ভরাটসহ সড়ক নির্মাণের কাজ করে। ওসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্র অনুযায়ী সড়ক নির্মাণের কাজ করেনি বলে সড়কটি উদ্বোধনের নয় মাসের মাথায় নির্মাণকাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠে।
এছাড়া এলাকাবাসী সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. একাব্বর হোসেন এমপির কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। সড়কটি নির্মাণে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে ওই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরে বিষয়টি স্থানীয় এমপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে।
পরবর্তীতে সংসদীয় কমিটি সভা করে বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। গঠিত কমিটি ২০১৮ সালের ২০ মার্চ মঙ্গলবার সরেজমিন মির্জাপুর-ওয়ার্শী-বালিয়া সড়কটির তদন্তে আসে। সেই সময় ওই সংসদীয় তদন্ত কমিটি অনিয়মের সত্যতা পায়।
তদন্ত কমিটি এই আঞ্চলিক সড়কটি তদন্তে এসে সড়ক নির্মাণে অনিয়মের সত্যতা পেয়েছেন বলে কমিটির প্রধান নাজমুল হক প্রধান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
এ বছর দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় মির্জাপুরের সড়কটিসহ সব আঞ্চলিক সড়কের বিভিন্ন অংশ পানিতে নিমজ্জিত হয়। পানির স্রোতে সড়কের উপজেলা সদরের পোষ্টকামুরী, রাজনগর, ঘুঘি, উত্তর রোয়াইল অংশসহ বিভিন্ন অংশে ভাঙন ধরে। বন্যার পানি কমার ফলে সড়কে ভাঙন ও গর্ত দেখা দেয়। দুর্ভোগ বাড়তে থাকে এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী মানুষের। সড়ক পথে চলতে গিয়ে মানুষ এখন বিকল্প হিসেবে নৌকা ব্যবহার করছেন। এতে সময় লাগছে বেশি এবং বাড়তি টাকাও খরচ হচ্ছে।
এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার বিকেলে সড়কটির উত্তর রোয়াইল সেতুর দক্ষিণ পাশে নিচ থেকে মাটি ধসে প্রায় ৩০ ফুট পাকা সড়ক ভেঙে গেছে। এতে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সেতুর ওপর দিয়ে মানুষ হেঁটেও চলাচল করতে পারছে না। খালের পানির তীব্র স্রোত প্রবাহিত হওয়ায় সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এছাড়া সেতুর পাশে মিনুর রহমান, হারাধন সরকার, আফাজ উদ্দিন ও ফজল হকের বাড়ি হুমকির মুখে পড়েছে। সেই সঙ্গে সড়কটির বিভিন্ন স্থানে যানবাহন উল্টে প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা।
উত্তর রোয়াইল গ্রামের মিনুর রহমান ও হারাধন সরকার বলেন, সেতুর দক্ষিণ পাশের সংযোগ সড়কে ফাটল দেখা যায়। পরে সড়কটি ধসে পড়ে।
স্থানীয় বাসিন্দা আশিষ, রুবেল, মজিবর, সনজিত, মুক্তার ও সবির বলেন, রাস্তাটি ভাঙনের ফলে চলাচলে খুবই কষ্ট হচ্ছে।
সিএনজিচালক মুক্তি মিয়া, শহিদুল ও আলমগীর হোসেন বলেন, আমরা যাত্রী নিয়ে ধামরাই, সাটুরিয়া, মানিকগঞ্জ, নবীনগর, নাগরপুরসহ দক্ষিণে বিভিন্ন স্থানে চলাচল করি। সড়কটির পোষ্টকামুরী, ঘুঘী ও উত্তর রোয়াইল নামক স্থানে ভাঙন থাকায় মির্জাপুর সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এছাড়া আমাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সড়কটি মেরামতের জোর দাবি জানাই।
ওয়ার্শী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ফরহাদ মিয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা শাজাহান মিয়া জানান, সড়কটির নির্মাণকাজ নিম্নমানের হওয়ায় অল্পদিনে ধসে গেছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের মির্জাপুর অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. এনামুল কবির বলেন, মির্জাপুর-ওয়ার্শী-বালিয়া আঞ্চলিক সড়কের বিভিন্ন স্থান ধসে যাওয়ার কথা শুনেছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সড়কটি পরিদর্শনে যাবে। এরপর সড়কটি সংস্কার করা হবে।
এস এম এরশাদ/এএম/পিআর