সুন্দরবনে বেড়েছে বাঘের সংখ্যা
বিশ্ব বাঘ দিবস আজ ২৯ জুলাই। বাঘ টিকে আছে বিশ্বে এমন ১৩টি দেশে ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে গত ৩ বছরে বাঘের সংখ্যা ১০৬ থেকে বেড়ে বর্তমানে ১১৪টি হয়েছে। অর্থাৎ ৩ বছরে সুন্দরবনের বাঘ বেড়েছে ৮টি।
‘বাঘ বাড়াতে করি পণ, রক্ষা করি সুন্দরবন’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এ বছর দেশে বাঘ দিবস পালিত হচ্ছে। করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে বন বিভাগ সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
গত বছরের ২২ মে সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ রয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্র্যাকিং জরিপের মাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত হয় বন বিভাগ। বিগত সময়ের থেকে বর্তমানে সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য কমে যাওয়ায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘের সংখ্যা বেড়েছে বলে দাবি তাদের।
বাংলাদেশে বাঘের একমাত্র আবাসস্থল সুন্দরবনকে দিনের পর দিন অরক্ষিত করে ফেলায় চরম হুমকির মধ্যে ছিল দেশের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার। যদিও বর্তমানে এই অবস্থার উন্নতি হয়েছে। অথচ রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবার্গ শহরে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সে প্রেক্ষিতে সুন্দরবন সন্নিহিত জেলা বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত সুন্দরবনে বসবাসকারী রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা তেমনটি বাড়েনি। সর্বশেষ বাঘ জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে ১১৪টি বাঘ থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সুন্দরবনের ঘনত্ব অনুযায়ী কমপক্ষে ২০০টি বাঘ থাকার কথা।
মানুষের তৎপরতা তথা অবৈধ শিকার, খাবারের অভাব ও প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগসহ সুন্দরবনের ভেতরে নদীতে নৌযান চলাচল এবং বনের পাশে শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ বাঘের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে ‘বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের ঘনত্ব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
২০১৫ সালের ২৬ জুলাই প্রকাশিত ক্যামেরা পদ্ধতীতে বাঘ গণনার জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। ওই সময় ভারত-বাংলাদেশ মিলে পুরো সুন্দরবন জুড়ে বাঘের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছিল ১৭০টি যা এর আগের শুমারি থেকে ২৭০টি কম। অথচ ২০০৪ সালে বন বিভাগ এনএনডিপির সহায়তায় প্রথমবারের মতো বাঘের পায়ের ছাপ গুণে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করেছিল ৪৪০টি। দু’বছর পর ২০০৬ সালে ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনা করে এর সংখ্যা নির্ধারণ করে ২০০টি।
ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। গত বছরের ২২ মে সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১০৬ থেকে বেড়ে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৪টিতে। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত বন বিভাগের হিসেবে ৫৩টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে মাত্র ১৫টি। লোকালয়ে ঢুকে পড়া ১৪টি বাঘকে পিটিয়ে মেরেছে স্থানীয় জনতা, একটি নিহত হয়েছে ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডরে ও বাকি ২৫টি বাঘ হত্যা করেছে চোরা শিকারিরা। অধিক মুনাফার আশায় বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, চামড়া, হাড়, দাঁত, নখ পাচার ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। আর এটি দেশ ও দেশের বাইরে চলে যেত চোরকারবারি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। তবে আশার খবর হচ্ছে সুন্দরবনে একের পর এক বনদস্যুদের আত্মসমর্পণে বাঘ নিধন কমে এসেছে।
সুন্দরবনে চোরা শিকারির পাশাপাশি বাঘের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে হুমকির মুখে রয়েছে বাঘ। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। এ অবস্থায় হারিয়ে যেতে পারে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ২০৭০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বাঘের জন্য কোনো উপযুক্ত জায়গা থাকবে না। কেননা বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধিসহ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সুন্দরবনে টিকে থাকা কয়েকশ বাঘ বিলীন হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই অবস্থায় সুন্দরবনে বাঘের আবাসভূমি এখন চরম হুমকির মুখে পড়েছে।
সুন্দরবনে একসময় চোরা শিকারি আর বনদস্যুদের হাতে একের পর এক বাঘ নিধন হত। তবে ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত সুন্দরবন ও লোকালয়ে বাঘের হামলায় ২ শতাধিক মানুষ মারা যায় ও প্রায় একশ জেলে-বনজীবী আহত হয়েছেন বলে বন বিভাগ সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আশার কথা হলো বর্তমানে সুন্দরবন সুরক্ষাসহ বাঘের প্রজনন, বংশবৃদ্ধিসহ অবাধ চলাচলের জন্য গোটা সুন্দরবনের আয়তনের ২৩ ভাগ থেকে ৫১ ভাগ এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এতে করে বাঘের প্রজনন, বংশবৃদ্ধিসহ অবাধ চলাচলের ব্যবস্থা নেয়ায় বাঘ কিছুটা হলেও স্বস্তির মধ্যে রয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর একে ফজলুল হক বলেন, বাঘ কমার অন্যতম কারণ চোরা শিকারি ও বনদস্যুদের দ্বারা বাঘ নিধন। বাঘের মূল্য অনেক বেশি। তাই দ্রুত চোরা মার্কেটে চলে যাচ্ছে। সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বাড়াতে আবাসস্থল, খাবার ও প্রজনন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এজন্য বন বিভাগকে দায়িত্ব নিতে হবে।
বন ভবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (প্রশাসন) ডিএফও মো. মাহমুদুল হাসান জানান, বাঘের সংখ্যা বাড়াতে তাদের বিচরণ ও প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে প্রজনন মৌসুমের ৩ মাস পর্যটন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বন বিভাগ। বর্তমানে বাঘ মারা যাচ্ছে না। সুন্দরবন পাহারায় স্মার্ট প্রেট্রোলিং টিম কাজ করছে। এতে করে সুন্দরবনে প্রজনন, বংশবৃদ্ধিসহ বাঘ অবাধে চলাচল করতে পারবে।
প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) মো. আমীর হোসাইন চৌধূরী জানান, সুন্দরবনে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা ও চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য কম হওয়ায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘের সংখ্যা সর্বশেষ জরিপে বেড়েছে। ইতোমধ্যেই বাঘের প্রজনন, বংশ বৃদ্ধিসহ অবাধ চলাচলের জন্য গোটা সুন্দরবনের আয়তনের ২৩ ভাগ থেকে ৫১ ভাগ এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এতে করে প্রজনন, বংশ বৃদ্ধিসহ বাঘের অবাধ চলাচলের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বাঘ রক্ষায় বন বিভাগের পাশাপাশি কোস্টগার্ড ও র্যাব তৎপর রয়েছে।
এফএ/জেআইএম