স্ত্রীর চোখেই পৃথিবী দেখেন দৃষ্টিহীন সুমন্ত
বৈঠা হাতে ট্রলারের সঙ্গে দ্রুত গতিতে নৌকা চালিয়ে যাচ্ছেন মধ্য বয়সী এক নারী। দেখে মনে হবে ট্রলারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছেন তিনি। আসলে তা নয়, দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে নৌকা চালাতে চালাতে এমন পারদর্শী হয়েছেন তিনি। জীবন সংগ্রামের কারণেই সংসার চালাতে শক্তহাতে নৌকার বৈঠা হাতে নিয়েছেন পুষ্প রানি।
জীবন সংগ্রামী নারী পুষ্প রানির স্বামী সুমন্ত সমাদ্দার ঝালকাঠি সদরের কৃত্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলি গ্রামের একজন চাষি। ১৯৯৪ সালে একটি দুর্ঘটনায় অন্ধ হন তিনি। এ অবস্থায় ১৯ বছর আগে বিয়ে করেন বানারীপাড়ার মেয়ে পুষ্পকে। সংসার জীবনে তিন ছেলে-মেয়ের বাবা সুমন্ত। বড় মেয়ে পিংকির বয়স ১৮ বছর, ছেলে সুমনের ১০ ও ছোট মেয়ে লক্ষ্মীর বয়স ৬ বছর।
সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে পড়াশোনা করানোর ইচ্ছে থাকলেও আর্থিক সংকটের কারণে তা পেরে ওঠেন না। সংসার চালাতে অর্থ উপার্জনে ক্ষেত-খামারে কাজ করে থাকেন পুষ্প, তার সঙ্গে মাঝে মধ্যে যান সুমন্ত। তবে তার মজুরি না থাকায় বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় কাটান তিনি।
বসতঘর আর এক খণ্ড জমি ছাড়া আর কিছুই নেই দৃষ্টিহীন সুমন্ত সমাদ্দারের। সেই বাড়ির চারপাশে ছোট ছোট নালা-খাল বয়ে যাওয়ায় বারো মাসই তাদের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম ডিঙি নৌকা। পুরাতন নৌকাটি ভেঙে যাওয়ায় সেটি ঘাটেই বাঁধা আছে। এরপর নতুন একটি নৌকা নিয়ে স্ত্রীর হাত ধরে সংগ্রামী জীবন পার করে যাচ্ছেন কোনো রকমে। স্ত্রীর ভালোবাসায় তিন সন্তান নিয়ে বেশ ভালো আছেন ৪৫ বছর বয়সী সুমন্ত।
স্ত্রী পুষ্প রানী বলেন, আমার সব কাজ সহজ ও গতিশীল করে দেন তিনি। সুমন্ত অনেক ভালো একজন মানুষ। যে কারণে তার সঙ্গে সংসার করছি। সে কখনোই আমার কোনো কষ্টের কারণ হয়নি। ক্ষেত-খামারে বা অন্যের বাড়িতে যখন কাজে যাই, সে সঙ্গে যায়, বসে যে কাজগুলো করা সম্ভব সেগুলো করে, এগিয়ে দেয়।
পেয়ারা বাগান আর সবজি চাষাবাদ সবমিলিয়ে অভাব থেকে মুক্ত হয়ে সফল আত্মসংগ্রামী হিসেবে পুস্প রানী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার এ উদ্যোগী কার্যক্রমে সহায়তা করছেন তার দৃষ্টিহীন স্বামী সুমন্ত সমদ্দার।
পুষ্প রানী আরও বলেন, আমি নৌকার পেছনে বসে হাল ধরে বৈঠা বেয়েছি আর সে সামনে বসে বৈঠা বেয়ে গতি বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। যার ফলে স্বল্প সময়ে চলাচল করতে পারি। এভাবে আমার সব কাজের সহায়ক হিসেবে কাজ করছে সে।
সুমন্ত সমাদ্দার বলেন, এই বাড়ির ভিটেটুকু ছাড়া কিছু নেই। বছরের বিভিন্ন সময় স্ত্রী মানুষের বাড়িতে গিয়ে কাজ-কর্ম করে যে টাকা আয় করে তা দিয়ে সংসার চলে। সেখান থেকে সে কিছু টাকা দিয়ে পেয়ারার ৩টা একশ ফুট লম্বা কান্দি বরগা নিয়েছে গাছসহ। বাগান থেকে আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসজুড়ে প্রায় প্রতিদিনই ২-৩শ টাকার পেয়ারা বিক্রি করছি।
তিনি আরও বলেন, পেয়ারার ফলনে দেরি হয়েছে। এছাড়া প্রতিবছরের চেয়ে এ বছর ফলনও কম হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন ব্যয় বেশি হয়েছে। তাই এইবার মৌসুমের শুরুতেই ১০ থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে প্রতি মণ পেয়ারা বিক্রি করতে হচ্ছে।
সুমন্ত সমাদ্দারের চাচাতো ভাই পরিমল সমাদ্দার জানান, স্ত্রীর হাত ধরেই বছরের পর বছর এগিয়ে চলছে অন্ধ সুমন্ত। পুষ্পর কারণেই বেঁচে আছে তারা।
আতিকুর রহমান/এফএ/পিআর