বাঁশ যখন মানুষের বিপদের সঙ্গী!
ইদানিং মানুষ দৈনন্দিন কথাবার্তায় ‘বাঁশ’কে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামের মানুষের বিপদের বন্ধু বাঁশ। গ্রামটিতে বাঁশঝাড় নেই এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রাস্তার দুই পাশে ও বাড়ির আঙিনা কিংবা খোলা জায়গায় থাকা বাঁশঝাড় গ্রামের মানুষের পরম বন্ধু হয়ে উঠেছে।
শুধুমাত্র বাঁশ বিক্রির জন্য গ্রামটিতে ৫০ বছরেরও বেশি পুরনো একটি হাট রয়েছে। সপ্তাহে দুইদিন বসা ওই হাটে কয়েক লাখ টাকার বাঁশ বিক্রি হয়। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে হাটটিকে আরও বেশি চাঙ্গা করার দাবি জানিয়েছেন গ্রামবাসী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষের বসবাস। কৃষিকাজই এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের জীবন ও জীবিকা। চাষের জন্য জমির মাটি ভালো হওয়ায় ধান ও শাক-সবজির পাশাপাশি বিভিন্ন ফলমূলেরও চাষাবাদ হয় পাহাড়পুরে। তবে পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে চাষ না হলেও গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই বাঁশঝাড় রয়েছে।
ঘরের পালা থেকে শুরু করে গৃহস্থালির নানা কাজে ব্যবহৃত হয় এই বাঁশ। তরকারি হিসেবেও রান্না করে খাওয়া যায় বাঁশের কুড়ল। গ্রামের অনেকেই আর্থিক টানাপোড়েন দেখা দিলে বাঁশ বিক্রি করে সংসার চালিয়ে নেন। আবার এই বাঁশের ওপর ভর করেই গ্রামের অনেক মানুষ তিনবেলা খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন। তাই অনেকেই এখন বাণিজ্যিকভাবে বাঁশ চাষের কথা ভাবছেন।
পাহাড়পুর গ্রামের বাসিন্দা আফতাব মিয়া বলেন, কৃষিকাজ করে সংসার চালাই। বাঁশের চাষ না করলেও আমার বাড়িতে বাঁশঝাড় রয়েছে। বাড়ির পাশে খোলা জায়গায় অনেক আগে একবার চারা লাগিয়েছিলাম। সেই চারা থেকে হওয়া বাঁশঝাড় থেকে প্রতি বছর বাঁশ কেটে হাটে বিক্রি করছি। বছর বছর কোনো খরচ না করেই একেকটি বাঁশ দুই-তিনশত টাকায় বিক্রি করে সুন্দর দিন চলে যায়। যেদিন ঘরে রান্নার জন্য সদাই থাকে না সেদিন বাঁশঝাড় থেকে একটা বাঁশ কেটে বিক্রি করে সদাই কিনি।
আছিয়া বেগম নামে এক গৃহবধূ জানান, তার স্বামীর অসুস্থতার সময় বাড়িতে থাকা বাঁশঝাড়ের বাঁশ বিক্রি করে চিকিৎসার অর্ধেক খরচ মিটিয়েছেন। এখন সংসারের টুকিটাকি খরচ আসে বাঁশ থেকেই। চিন্তা করছেন বাড়ির পাশে পড়ে থাকা জায়গায় বাঁশের চাষ করবেন। এতে করে আর্থিকভাবেও স্বাবলম্বী হতে পারবেন তিনি।
পাহাড়পুর গ্রামের বাটিরপাড়া মাঠে প্রায় শতবছর ধরে বসছে বাঁশের হাট। গ্রামের লোকজনই তাদের বাড়ির বাঁশঝাড়ের বাঁশ কেটে নিয়ে আসেন হাটে। হাটটিতে এখন চার প্রজাতির বাঁশ পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো হলো- বরাক, মাহাল, পেঁচী ও নলজাই বাঁশ। একেকটি বাঁশ ২০ থেকে ৩৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ অনুযায়ী একেকটি বাঁশ একশ থেকে তিনশ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
প্রতি সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার বসা এই হাটে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে বাঁশ কিনে নিয়ে যান। এসব বাঁশ দিয়ে ঘরের বেড়া, খুঁটি, ডুলা, খালুই, গরুর মুখবন্ধনী, ফুলদানি, কুলা ও হাঁস-মুরগির খাঁচাসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। বর্তমানে প্রতি হাটে এক থেকে দেড় লাখ টাকার বাঁশ বিক্রি হয়। তবে বর্ষাকালে বেচাকেনা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। তখন প্রতি হাটে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকার বাঁশ বেচা কেনা হয়।
প্রতি বছর এই হাটটি ইজারা দেয় বিজয়নগর উপজেলা প্রশাসন। চলতি বছর ৩০ হাজার টাকায় হাটটি ইজারা নিয়েছেন পাহাড়পুর গ্রামের ব্যবসায়ী বাবুল আহমেদ। হাটে আসা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি বাঁশে দুই টাকা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দুই টাকা করে পান ইজারাদার। তবে সাধারণ কোনো হাটে যে অবকাঠামো থাকে তার কোনোকিছুই নেই বাটিরপাড়া মাঠের এই বাঁশের হাটে। তাই অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে হাটটিকে আরও চাঙ্গা করে জেলার বাইরের ব্যবসায়ী আসার পরিবেশ তৈরির দাবি জানিয়েছেন ইজারাদার ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
পাহাড়পুর বাঁশ বাজারের ইজারাদার বাবুল আহমেদ জানান, একসময় হাটটি অনেক জমজমাট ছিল। তখন বাঁশ ছাড়া অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর দোকানও ছিল। কয়েক বছর ধরে গ্রামে মনাবাজার নামে আরেকটি হাট বসছে। সেজন্য এখন শুধু এই হাটে বাঁশই বিক্রি হয়। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে মনাবাজারটি এখানে স্থানান্তর করলে এই হাট আরও বেশি চাঙ্গা হবে। এতে করে সরকারও লাভবান হবে।
এফএ/পিআর