করোনার মধ্যে বন্যা : দুর্দিনের মেঘ দেখছে কুড়িগ্রামবাসী

একদিকে করোনা অপরদিকে বন্যা। এই দুই দুর্যোগ একসঙ্গে মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কুড়িগ্রামবাসী। এই দুর্যোগে বেশি বিপাকে পড়তে হচ্ছে দিনমজুর আর নিম্ন আয়ের মানুষদের। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে অভাবের আশংকা দেখা দিতে পারে দারিদ্র্যপীড়িত জেলাটিতে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের ধরলা নদী ঘেঁষা গ্রাম জগমোহনচর। এই গ্রামের বাসিন্দা আকলিমা (৪০) ও ইউনুস আলী (৪৫)। আকলিমা একজন গৃহিনী আর ইউনুস আলী দিনমজুর। ঘরে তাদের তিন সন্তান। সপ্তাহ খানেক আগে ধারদেনা করে ১৫ হাজার টাকা খরচ করে মেয়ের সিজার করিয়েছেন। করোনার কারণে হাতে নেই কোনো কাজকর্ম। ইউনুস আলী ঢাকায় রিকশা চালাতেন। কিন্তু করোনার কারণে এবার আর ঢাকা কিংবা অন্য জায়গায় যেতে পারেননি। ফলে এলাকাতেই দিনমজুরি করে ২/৩শ টাকা যা আয় হতো তাই দিয়ে সংসার চলতো। কিন্তু টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে বন্যার মধ্যে একমাত্র বসতভিটে ধরলা নদীর করাল গ্রাসের মুখে পড়েছে। তাই খেয়ে না খেয়ে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে হচ্ছে তাদের। এমন দুর্যোগে পরিবার নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ইউনুস আলী।
আকলিমা ও ইউনুস আলীর মতো জেলার দিন এনে দিন খাওয়া হাজার-হাজার মানুষের দিন কাটছে এমন হাহাকার অবস্থায়। করোনা থেকে বাঁচবে নাকি বন্যা মোকাবিলা করবে এই ভেবে দিন কাটছে নিম্ন আয়ের মানুষজনের। কৃষি নির্ভরশীল এই জনপদে কলকারখানা না থাকায় সারা বছর কাজের সুযোগও কম। ফলে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে সেই জমানো অর্থ দিয়ে প্রতিবছরের বন্যা মোকাবিলা করে আসছে অভাবগ্রস্ত এই জেলার মানুষ।
বিগত বছরের বন্যার সময় নদ-নদীর তীরবর্তী মানুষজন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে দিনমজুরিসহ বিভিন্ন কাজ করে অর্থ আয় করে থাকেন। সেই টাকায় বন্যার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে শুকনো খাবার কিনে রাখতেন। কিন্তু এবারের চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাউনে কাজের সুযোগ ছিল না। এতে খেটে খাওয়া মানুষদের নিজ এলাকাতেই অবস্থান করতে হয়েছে কয়েক মাস। করোনার সময় অনেকেই কৃষি শ্রমিক, রিকশা-ভ্যান চালিয়ে, দিনমজুরি করে কিংবা সঞ্চয়কৃত এবং সরকারি সহায়তা দিয়ে আগের দিনগুলো কাটিয়েছেন। করোনার দুর্যোগ কোনো রকমে কাটানোর চেষ্টা করলেও বন্যা এসে পড়ায় গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ সম্পদ নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বা উঁচু স্থানে। এসব সম্পদ নিয়ে গাদাগাদি করেই দিনরাত পার করতে হচ্ছে বানভাসীদের।
করোনার কারণে নিজের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবন রক্ষা করবে নাকি সম্পদ রক্ষা করবে এই নিয়ে বিপাকে পড়েছে বানভাসীরা। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘাঁ।
বন্যা কবলিত পরিবারগুলো হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আগাম বন্যা আসায় চরাঞ্চলে আবাদকৃত পাট, আউশ, সবজি, আমন বীজতলা, তিল, কাউনসহ ফসলি জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। ঋণ কিংবা সুদে ধারদেনা করে এসব ফসল ফলালেও বন্যার পানিতে সেগুলো এখন নষ্ট হওয়ার পথে। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে দারিদ্র্যপীড়িত জেলায় দেখা দিতে পারে অভাব। ফলে এই জনপদের মানুষদের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারি-বেসরকারিভাবে জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি স্থানীয়দের।
ইউনুস আলী ও আকলিমা বেগম জানান,যেভাবে দুর্যোগ মোকাবিলা করছি তাতে বেঁচে থাকা না থাকা সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে বাইরে গিয়ে কাজ-কর্ম করে সংসার ভালোই চলত। কিন্তু এবার এক বেলা খাবার জুটলেও পরের বেলা চিন্তা করতে হয়। বাচ্চাদের নিয়ে খুবই কষ্টে দিন কাটছে।
একই ইউনিয়নের নন্দদুলালের ভিটা গ্রামের বাসিন্দা আব্বাস আলী, শহিদুল ইসলাম, রুস্তম মিয়া জানান, জেলায় সারাবছর কাজ করার সুযোগ কম। শিল্প কারখানা না থাকায় মৌসুমী কাজ জোটে এখানে। সেটাও ধান কাটা ও ভাটায় কাজ করার সুযোগ। ফলে এখানকার দিনমজুর শ্রমিকরা জেলার বাইরে গিয়ে কাজ করে সংসার চালায়। কিন্তু করোনার কারণে এবার সেটাও বন্ধ রয়েছে। করোনার সময় সরকারের দেয়া সহায়তা না পাওয়ারও অভিযোগ করেন তারা।
যাত্রাপুর ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী অকপটে স্বীকার করলেন খেটে খাওয়া মানুষদের দুর্ভোগের কথা। হাতে কাজ না থাকায় মানুষের সঞ্চয়কৃত অর্থ ফুরিয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষজন।
তিনি বলেন, করোনার সময় সরকার সহায়তা দিলেও বন্যার কারণে এই চাহিদা আরো বেড়ে যাবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, করোনা এবং বন্যার সময় দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ নেই। তবে যারা শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন কাজে অন্য জেলায় যেতেন তাদের তালিকা করার পাশাপাশি ক্ষুদ্র-কুটির শিল্প উদ্যোক্তাদের ঋণ সহায়তাসহ পণ্য বাজারজাত করার বিষয়ে আশ্বাস দেন তিনি।
নাজমুল হোসেন/এফএ/পিআর