মা-বোনকে খুঁজছেন রিফাত
মা ময়না বেগম, বোন মুক্তা আক্তার ও বন্ধু রিপনকে সঙ্গে নিয়ে মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন রিফাত আহমেদ। সোমবার (২৯ জুন) সকাল সোয়া ৯টার দিকে লঞ্চটি যখন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের কাছাকাছি পৌঁছে তখন হুইসেল বেজে ওঠে। রিফাত, তার মা ও বোন লঞ্চ থেকে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ওই সময় রিপন লঞ্চের ছাদে ছিলেন।
হঠাৎ করে সদরঘাটের শ্যামবাজার পয়েন্টে ময়ূর-২ নামের লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায় মর্নিং বার্ড লঞ্চটি। লঞ্চডুবির ঘটনার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন ওই লঞ্চে থাকা রিফাত। কীভাবে এত বড় ঘটনা ঘটেছে তা নিজের চোখে দেখেছেন তিনি।
‘হঠাৎ করে একটি লঞ্চ আমাদের লঞ্চকে ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের লঞ্চটি উল্টে যায়। এ সময় মায়ের হাত ধরার চেষ্টা করি। কিন্তু পারিনি। মায়ের হাত ধরতে গিয়ে প্রচণ্ড আঘাত পাই আমি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অন্ধকার দেখতে শুরু করি। আমাদের লঞ্চ ডুবে যাচ্ছে। পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছি। যত গভীরে যাচ্ছে লঞ্চ ততই আমার দম বের হয়ে যাচ্ছিল। এরপর চারদিকে পানি ছাড়া আর কিছুই দেখিনি’ জাগো নিউজকে বলছিলেন রিফাত আহমেদ।
রিফাত বলেন, লঞ্চ ডুবে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই পানিতে ভেসে উঠি আমি। এরপর সাঁতরে নদীর কূলে যাই। নদীর কূলে পানিতে দাঁড়িয়ে মা ও বোনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। ভেবেছিলাম তারাও ভেসে উঠবে। এভাবে কেটে যায় ১০-১৫ মিনিট। কিন্তু ততক্ষণেও আমার মা-বোনের দেখা পাইনি। এর কয়েক মিনিট পর আমার মায়ের হাতে থাকা ব্যাগ পানিতে ভেসে ওঠে। মায়ের ব্যাগ পানিতে ভেসে উঠতে দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এরপর কি ঘটেছে আমি জানি না।
ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল জানায়, লঞ্চটি থেকে কয়েকজন যাত্রী সাঁতরে পাড়ে উঠলেও বেশ কয়েকজন নিখোঁজ হন। এর মধ্যে অজ্ঞান অবস্থায় রিফাতকে উদ্ধার করা হয়। পরে চিকিৎসা দিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলা হয়। তবে রিফাতের মা ও বোনের সন্ধান মেলেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রিফাত আহমেদের বাবা মালয়েশিয়ায় থাকেন। তবে বাবার সঙ্গে রিফাতের পরিবারের যোগাযোগ নেই। পাঁচ বছর ধরে বাবার কাছ থেকে দূরে রয়েছেন রিফাত ও তার বোন। দুই সন্তানকে নিয়ে আলাদা থাকছেন রিফাতের মা। রিফাতের মা ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
রিফাত এসএসসি পাস করার পর অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে পারেননি। পরে একটি জুতার দোকানে কাজ করে মায়ের পাশাপাশি সংসারের হাল ধরেন। তার উপার্জনের টাকা দিয়ে মা ও ছোট বোনকে নিয়ে পুরান ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। কিছুদিন আগে মা আর বোনকে নিয়ে ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার আমতলী এলাকায় নানা রাজ্জাক শেখের বাসায় বেড়াতে যান রিফাত।
নানা বাড়িতে বসে রিফাতের মা বলেছিলেন, এবার ঢাকায় ফিরে ছেলের জন্য ভালো একটা চাকরির ব্যবস্থা করবেন। যাতে ছেলের ভবিষ্যতে কষ্ট না করতে হয়। তাই ছেলের স্বপ্ন পূরণে ঢাকা ফিরছিলেন মা। কিন্তু সেই স্বপ্ন মুহূর্তের মধ্যে ডুবে গেল বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে। মা-বোনকে হারিয়ে চিরতরে একা হয়ে গেলেন বাবাহারা রিফাত।
রিফাত আহমেদ বলেন, আমার আম্মার স্বপ্ন ছিল আমি যেন ভালো একটা চাকরি করি। চাকরির পাশাপাশি আমি যেন উচ্চশিক্ষাও গ্রহণ করি। আমার বোনও লেখাপড়া করে। করোনার কারণে আমরা ঢাকা থেকে গ্রামে যাই। আমার আম্মু সবসময় বলতেন ভালো মানুষ হও। আম্মুর কথার অবাধ্য হইনি কখনও। এখন আমার আম্মু কোথায় হারিয়ে গেল? আমার বোন মুক্তা কোথায়? চিরতরে একা হয়ে গেলাম আমি।
রিফাত বলেন, ময়ূর লঞ্চের খামখেয়ালিপনায় আজ আমি মাকে হারালাম, বোনকে হারালাম। আমার মা-বোন এখন কেবলই ছবি। আমার পরিবার শেষ। সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। কে করবে এর বিচার? আমি ওই লঞ্চ মালিকের কঠিন শাস্তি চাই।
এএম/এমকেএইচ