করোনাকালে ‌‘মুনাফা না’ টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যবসায়ীরা

সাইফ আমীন
সাইফ আমীন সাইফ আমীন , নিজস্ব প্রতিবেদক বরিশাল
প্রকাশিত: ০১:১৫ পিএম, ২৩ জুন ২০২০

করোনা ভাইরাসের বড় ধাক্কা লেগেছে সারা দেশের অর্থনীতিতে। বরিশালও এর বাইরে নেই। এর মাঝেই মন্দার হাতছানি বরিশালের অর্থনীতিতে। যার ফলে অসংখ্য কর্মচারী ও শ্রমিক এখন চাকরি হারানোর আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। আবার অনেকেই এরই মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন। রোজগারের উৎসগুলো সংকুচিত হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনধারণে নাভিশ্বাস উঠেছে। শুধু নিম্ন আয়ের মানুষই নয়, মধ্যবিত্তরাও রয়েছেন নানা সংকটে। যারা এখন কর্মে আছেন, তারাও বলছেন জীবিকা অর্জন ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

গত কয়েক বছর ধরে চলা ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বরিশালের অবস্থারও উন্নতি হচ্ছিল, হতদরিদ্রের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছিল। কিন্তু করোনার কারণে হঠাৎ বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটেছে। প্রায় বিপর্যস্ত পুরো এলাকার অর্থনীতি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বরিশালে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগ বন্ধ হয়েছে। চাকরি হারিয়েছেন বা ছাঁটাই হয়েছেন কয়েক হাজার শ্রমিক ও কর্মচারী। একজনের উপার্জনে গোটা পরিবার চলত যাদের তারাই পড়েছেন বেশি বিপদে। একমাত্র আয়ের পথ যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে অন্য কিছু করার কোনো পরিস্থিতি এখন নেই। করোনা পরিস্থিতিতে জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা কী হবে তা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সবাই। পরিবার চালাতে বিপাকে পড়েছেন নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তরা।

Barishal-2

সংশ্লিষ্ঠ সূত্র বলছে, বরিশালের মানুষের কেনাকাটার একটি বড় কেন্দ্র চকবাজার-কাঠপট্টি-লাইনরোড-পদ্মাবতি-বড় বাজার। সেখানে শাড়ি-কাপড় ছাড়াও বিভিন্ন পণ্য সমগ্রী খুচরা ও পাইকারি বিক্রি হয়ে আসছে। ওই সব এলাকায় সহস্রাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কয়েক হাজার কর্মচারী-শ্রমিক কাজ করেন। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কাজ না থাকায় বেকার হয়েছেন তাদের অনেকেই। আবার যারা টিকে আছেন তাদের বেতন কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে।

বরিশাল মহানগর দোকান কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি স্বপন দত্ত জানান, তার সংগঠনে ৭৭৪ জন সদস্য রয়েছেন। এরমধ্যে সবাই দোকান কর্মচারী। গত ২৫ মার্চের পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন দোকান থেকে অর্ধশতাধিক কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। আর যারা কাজে আছেন, তাদের পূর্বের বেতনের অর্ধেক দেয়া হচ্ছে। তাই কর্মচারীরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন।

চকবাজার-কাঠপট্টি-লাইনরোড-পদ্মাবতি ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ আব্দুর রহিম জানান, এই সমিতির সদস্য সংখ্যা সাড়ে চারশ। প্রত্যেক সদস্যেরই দোকান আছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে গত ৩ মাসে এসব দোকান মালিকের ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখনও তেমন বিক্রি হচ্ছে না। বিদুৎ বিল, দোকান ভাড়া, কর্মচারী বেতন ও আনুষাঙ্গিক খরচ মিলিয়ে গড়ে প্রতিদিন বড় দোকানগুলোর খরচ প্রায় ১০ হাজার টাকা। এরপরও কোনো দোকানমালিক কর্মচারী ছাঁটাই করেননি। তবে লোকসানের মুখে কর্মচারীদের বেতন ২০ শতাংশ কমানোর কথা স্বীকার করেন তিনি।

Barishal-3

অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতিতে লোকসানের অজুহাত তুলে ঈদুল ফিতরের আগে বরিশাল নগরীর রূপতলীর সোনারগাঁও টেক্সটাইল মিল নামের একটি কারখানা থেকে ৪ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়। এছাড়া বরিশাল নগরীর অলিম্পিক সিমেন্ট কারখানার দুই শতাধিক শ্রমিককেও ছাঁটাই করা হয়েছে। ওই দুই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা এখন কাজ ফিরে পেতে আন্দোলন ও বিক্ষোভ করেছেন। তবে তাতে কর্তৃপক্ষের মন গলেনি।

বরিশাল বিসিক শিল্প নগরীর শিল্প মালিক সমতির সভাপতি মিজানুর রহমান জানান, বিসিক শিল্প নগরীতে ক্ষুদ্র মাঝারি মিলিয়ে ৯৩টি কারখানা চালু ছিল। করোনার কারণে ৬৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রায় দুই হাজারের মতো শ্রমিক-কর্মচারী কাজ হারিয়েছেন। আর করোনা পরিস্থিতিতে কারখানা মালিকদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা।

মালিক সমতির সভাপতি মিজানুর রহমান জানান, করোনার কারণে সারাদেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরই অবস্থা এক। বহু প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেছে, অসংখ্য মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। এ বছরটা তাই টিকে থাকার বছর, মুনাফা করা সম্ভব নয়।

মিজানুর রহমান জানান, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। করোনার এই সময়ে সাধারণত কোনো ব্যবসায়ী তার প্রতিষ্ঠানের জনবল ছাঁটাই করতে চাইবে না। এরপরও করোনার এই দুর্দিনে জনবল ছাঁটাই করা যুক্তিসংগত নয়। আবার এ সময় নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগও কম।

Barishal-3

বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু জানান, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই টিকে আছে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য যে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এ রকম অবস্থা আগে কখনো হয়নি। করোনাতে বরিশালে এমন কোনো ব্যবসা খাত নেই যে সেখানে প্রভাব পড়েনি। বরিশালে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, পরিবহন, মৎস্যখাত, ডেইরি, কৃষি ও পোলট্রি শিল্পের ওপর বড় আঘাত এসেছে। এতে লোকসান কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

তিনি বলেন, যারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে এই করোনা পরিস্থিতি। লোকসানের মুখে পড়ে কিছু ব্যবসায়ী শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে আবার সময়মতো বেতন দিতে পারছেন না। এ অবস্থায় অর্থনীতির সব খাত ঠিক হতে কত সময় লাগবে তা কেউ বলতে পারছে না।

সাইদুর রহমান রিন্টু জানান, সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে, তা খুবই ইতিবাচক। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার জন্য এই প্রণোদনা ও সরকারের নানা উদ্যোগ খুব কাজে দেবে। সরকারের ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনার দ্রুত ও সহজ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।

এফএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।