জাতীয় রাজনীতিতে শহীদ এম মনসুর আলীর পরিবার

ইউসুফ দেওয়ান রাজু
ইউসুফ দেওয়ান রাজু ইউসুফ দেওয়ান রাজু সিরাজগঞ্জ
প্রকাশিত: ০২:৪০ পিএম, ১৩ জুন ২০২০

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জাতীয় নেতা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। এই মহান নেতার সুযোগ্যপুত্র সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ও জাতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বড় ছেলে ড. মোহাম্মদ সেলিমও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।

মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে সাবেক এমপি প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয়ও পিতামহ এবং পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে মানুষের সেবায় ব্রত রয়েছেন। এই রাজনৈতিক পরিবারটির নির্বাচনী এলাকা সিরাজগঞ্জ-১ অর্থাৎ কাজিপুর উপজেলা ও সিরাজগঞ্জ সদর থানার বহুলী, ছোনগাছা, বাগবাটি, রতনকান্দি ও মেছড়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত।

শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর পরিবারের সদস্যরা জাতীয় রাজনীতিতে যেমন অবদান রেখেছেন তেমনি নিজেদের নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। যমুনা নদীর করালগ্রাসে বিধ্বস্ত সিরাজগঞ্জ এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জেলায় নানামুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, ব্রিজ-কালভার্ট, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও ডিজিটাল প্রযুক্তি বিস্তারে বিভিন্ন স্থাপনার উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। শহীদ মনসুর আলীর পরিবার এই অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের চাকরিসহ নানামুখী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছে।

জাতীয় নেতা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী

বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আরও যাদের নাম লেখা রয়েছে তাদের মাঝে অন্যতম শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। তিনি জাতীয় নেতা। মাটি ও মানুষের কাছের মানুষ।

১৯১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ জেলা অর্থাৎ তদানীন্তন সিরাজগঞ্জ মহকুমারের কুড়িপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে এম মনসুর আলীর জন্ম হয়। তাঁর বাবা হরফ আলী সরকার ও মাতা বেগম রওশনারার পাঁচ পুত্র ও পাঁচ কন্যা সন্তানের মাঝে এম মনসুর আলী ছিলেন নবমতম। তিনি ভারতের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ও এলএলবি পাস করেন।

এম মনসুর আলীর সহধর্মিণী বেগম আমিনা মনসুর ছিলেন গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থানার আমিরুদ্দিন সরকারের মেয়ে। আমিরুদ্দিন সরকার ছিলেন তৎকালীন একজন স্বনামধন্য জেলা জজ। এম মনসুর আলী ও বেগম আমিনা মনসুর পাঁচ পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক-জননী। জাতীয় নেতা শহীদ এম মনসুর আলী ‘ক্যাপ্টেন মনসুর’ নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন না, ছিলেন পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড (পিএনজি)-এর পাবনা জেলার ক্যাপ্টেন। তবে তিনি যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন।

এম মনসুর আলী শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৪৬ সালে পাবনা বারে যোগদানের মাধ্যমে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। এ পেশায় শীর্ষস্থান অর্জন করতে তার বেশি দিন সময় লাগেনি। একনিষ্ঠতা এবং দক্ষতায় তিনি পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতির পরপর তিনবার সাধারণ সম্পাদক এবং পাঁচবার সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫৮ সালে যোগদান করেন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট বারে।

এম মনসুর আলী ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তখন থেকেই প্রখ্যাত ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে মনসুর আলী আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের যুবকর্মী হিসেবে তিনি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। এরপর ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির আগ পর্যন্ত তিনি পর্যায়ক্রমে আইন ও বিচার বিভাগ, খাদ্য, কৃষি, বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।

আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে অবৈধভাবে গ্রেফতার করের। তাঁর মাঝে এম মনসুর আলী অন্যতম। তিনি এই অবৈধ গ্রেফতারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে প্রায় এক বছর পর মুক্তি লাভ করেন।

বৃটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, পাবনার ভুট্টা আন্দোলন, পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬ দফা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা আপসহীন এবং স্মরণীয়। তিনি বহুবার শাসক গোষ্ঠী দ্বারা জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলে তিনি হতেন পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭০ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। রাতের অন্ধকারে হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেরণ করে। পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে ওঠে। জাতীয় নেতৃবৃন্দ মুক্তি সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণকল্পে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। শুরু হয় বাংলাদেশ সরকার গঠনের আয়োজন। একপর্যায়ে সরকার গঠন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। সফলভাবে সেই জটিলতার অবসান ঘটানোর ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এম মনসুর আলী। অবশেষে বাংলাদেশ সরকার গঠন হয় এবং সেই সরকারের অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়সহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন তিনি। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধে হাইকমান্ডের তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি যোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টসহ প্রায় সমস্ত অবকাঠামো ভেঙে পড়ে। এরপর ১৯৭৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এসে পরে তার হাতে। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশের সদ্য রচিত সংবিধানে স্বাক্ষর করেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা-১ (সিরাজগঞ্জ মহকুমার কাজিপুর) থেকে এম মনসুর আলী বিপুল ভোটে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি বঙ্গবন্ধুর নতুন রাজনৈতিক দল বাকশালের মহাসচিব নির্বাচিত হন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন করে সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্য। বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোস্তাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হলো। তার সরকারের হাতে হাত রাখলো সুবিধাভোগী অনেকেই। এম মনসুর আলী সে দিন সেনাপ্রধানসহ বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় ফোন করে প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও তিনি সাড়া পাননি। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান হয়ে পরেন তিনি। খুনি মোস্তাক মনসুর আলীকে তার সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান করলো। মনসুর আলী ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কারাবরণ করলেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে নির্মমভাবে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।

ড. মোহাম্মদ সেলিম

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে কয়জন সৎ, চরিত্রবান, আদর্শবান, দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতিক ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সুযোগ্য বড় সন্তান ড. মোহাম্মদ সেলিম। তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও কখনও নীতি আদর্শ বিসর্জন দেননি।

ড. মোহাম্মদ সেলিম ১৯৪৬ সালের ১৯ জুন জন্মগ্রহণ করেন। বাবা এম মনসুর আলী পাবনার আইনজীবী হওয়ায় সেলিমকে পাবনার জুবিলি স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করতে হয়। ১৯৬২ সালে তিনি রাধানগর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৬৪ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। অতঃপর ১৯৬৬ সালে ঢাকা কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করার পরে ১৯৭০ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে বার অ্যাট ল ডিগ্রি লাভ করেন।

সেলিম ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত হন। পরে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কাজীপুরে বাবার নির্বাচনী কার্যকলাপ পরিচালনা করেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি লন্ডনে চলে যান। ১৯৭৭-৭৮ সালে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করেন এবং সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করেন। যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন এমপি স্যার টমাস উইলিয়াম যিনি বঙ্গবন্ধুর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কৌঁসুলি ছিলেন তিনি এই সংগঠনের সভাপতি এবং ড. সেলিম ছিলেন সেক্রেটারি। ইংল্যাল্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এর শাখা গঠন করা হয়। এই সংগঠন বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় কন্যা শেখ রেহানাকে নিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। সে সময় দিল্লিতে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে লন্ডনে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে লন্ডনের বিখ্যাত ইয়র্ক হলে শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি করে প্রথম সভার আয়োজন করা হয়। এখানকার এই বিশাল সমাবেশে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার, চার জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারের দাবি উত্থাপন করেন। এরপর থেকে ইংল্যান্ডের বড় বড় শহরে শেখ হাসিনাকে নিয়ে সভা সমাবেশ শুরু হয় যায়।

ওই সময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার উদ্যোগে ড. সেলিম ও আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। সেই তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে তদন্ত কার্য পরিচালনার জন্য কৌঁসুলি পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তৎকালীন জিয়া সরকার কৌঁসুলি পাঠানোর অনুমতি দেয়নি।

পরে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব দিয়ে দেশে নিয়ে আসা হয় এবং ড. সেলিম বিদেশে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯০ সালে ড. সেলিম দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। ১৯৯৩ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে প্রেসিডিয়াম সদস্য মনোনীত হন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনাকে চেয়ারপারসন করে যে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করা হয় সেই কমিটিতে ড. সেলিম ছিলেন সদস্য সচিব। সেই নির্বাচনে সকল ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে পুনরায় সরকার গঠন করে।
সরকার গঠনের পর সিরাজগঞ্জ-১ (কাজীপুর) আসন থেকে উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ড. সেলিম। ১৯৯৮ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি ড. মোহাম্মদ সেলিম ৭১ বছর বয়সে লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

মোহাম্মদ নাসিম

বাবা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হওয়ার কারণে কারাগারে প্রাণ দিতে হয় ঘাতকের বুলেটে। আর সন্তান মোহাম্মদ নাসিম বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন। ছাত্রজীবন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন নাসিম। বিভিন্ন আন্দোলনে রাজপথে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাবার মতো তিনিও দেশের রাজনীতিতে একজন উজ্জল নক্ষত্র।

মোহাম্মদ নাসিম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। কিশোর বয়স থেকেই তিনি রাজনীতিবিদ বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাকিস্তান শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে মাঠে ছিলেন। ১৯৬৭ সালে পাবনায় বিখ্যাত ভুট্টা আন্দোলনে বাবার সঙ্গেই কারাবরণ করেন তিনি। ফলে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র নাসিম বন্দী অবস্থায় পাবনা কারাগারে বসে পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে আইএ পাস করেন। পরবর্তীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী নাসিম ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের পরে তিনি রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হয়ে যান। পঁচাত্তরের প্রেক্ষাপটেও তিনি ছিলেন ঘাতকদের নেশানায়। তাই তাঁকে পঁচাত্তর পরবর্তী ঘাতক সরকারের আমলে দেশের বাইরে অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদের সঙ্গে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে।

১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালেও সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তিনি সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৪-১৮ সরকারের মেয়াদে নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের সরকারে তিনি স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি ১৪ দলীয় মহাজোটের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রাজনীতির পাশাপাশি সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আছেন মোহাম্মদ নাসিম। ঢাকাসহ নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন।

ছাত্র জীবনের প্রথম দিকে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। পরে অল্প কিছু দিন ছাত্রলীগের রাজনীতিও করেন। ছাত্র রাজনীতি ছাড়ার পরে যুবলীগের রাজনীতি করলেও ১৯৮১ সালের আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন মোহাম্মদ নাসিম। ওই সম্মেলনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের যুব সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৮৭ সালের সম্মেলনে তিনি দলের প্রচার সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে মোহাম্মদ নাসিমকে দলের একমাত্র সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ২০০২ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে তাকে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য পদে রাখা হয়। এরপর ২০১২ সালের সম্মেলনে তাকে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপর টানা তিন মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন।

মোহাম্মদ নাসিম ভোটের রাজনীতিতে অত্যন্ত সফল। ১৯৮৬ সালে তিনি প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। সিরাজগঞ্জ-১ সংসদীয় আসন (কাজীপুর) থেকে ছয়বার বিজয়ী হয়েছেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন ১/১১ সরকারের দেয়া মামলার কারণে অংশগ্রহণ করতে পারেননি নাসিম। ওই নির্বাচনে তার সন্তান প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয়কে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে মোহাম্মদ নাসিমকে আবার মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। সে সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিম শনিবার (১৩ জুন) বেলা ১১টার দিকে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন

প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয়

প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয় নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের অঙ্গীকারবদ্ধ একজন তরুণ রাজনীতিবিদ। তিনি ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-১ (কাজিপুর) আসন থেকে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তারপর দীর্ঘ পাঁচ বছর নিজের এলাকার উন্নয়নে, এলাকার মানুষের সুখ-দুখে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তিনি পিতামহ জাতীয় নেতা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও পিতা মোহাম্মদ নাসিমের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এলাকার মানুষের পাশে থেকে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তানভীর শাকিল জয় তার এলাকার সর্বস্তরের মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় একটি নাম।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকার ক্ষমতায় এসে মোহাম্মদ নাসিমসহ দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে বিভিন্ন কারাগারে অন্তরীণ রাখে। সে সময় কাশিমপুর কারাগারে মোহাম্মদ নাসিম ব্রেইন স্ট্রোক করেন। মূলত তখনই তানভীর শাকিল জয়কে জনসম্মুখে আসতে হয়। বাবার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য সেই সরকারের সঙ্গে লড়তে হয়েছে তাকে। ভীষণ প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করে তিনি বাবাকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে সক্ষম হন। মোহাম্মদ নাসিম সিঙ্গাপুরে চিকিৎসারত অবস্থায় দেশে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আয়োজন শুরু হয়। সেখানেও নানা বৈরী পরিস্থিতির মোকাবেলা করে মানুষের ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যান তরুণ রাজনীতিক তানভীর শাকিল জয়।

তানভীর শাকিল জয়ের জন্ম ১৯৭৩ সালের ১ আগস্ট। তিনি মোহাম্মদ নাসিম ও লায়লা আঞ্জুমান বানু বীথির তিনপুত্র সন্তানের মাঝে প্রথম। তানভীর শাকিল জয় ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে স্টার মার্কসহ প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে স্টার মার্কসহ প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন। তারপর তিনি আমেরিকায় ভার্জিনিয়ার বিখ্যাত জর্জ ম্যাশন ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন।

আরএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।