বিনা বেতনে সেবা দেয়া সেই ক্ষিরোদ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত
ক্ষিরোদ কুমার হাজং। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক। সরকারি চাকরি না থাকলেও যিনি অনিয়মিত অনুদানে দীর্ঘদিন ধরে সেবা দিয়েছেন বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার রোগী ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের। করোনার দুর্যোগেও তিনি নিজেকে সরিয়ে রাখেননি। নিয়োজিত ছিলেন মানবতার সেবায়। কিন্তু করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাননি। করোনায় আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে তিনি বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইসোলেশনে।
করোনাভাইরাসের উপসর্গের রোগী নিয়ে আসা বা নমুনা পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হতো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একমাত্র বাহন অ্যাম্বুলেন্সটি। ক্ষিরোদকেও এ কাজে থাকতে হয়েছে সার্বক্ষণিক।
ক্ষিরোদ কুমার হাজং বলেন, আমার কোনো স্বার্থ নেই। এলাকার মানুষের উপকারের জন্য এই ক্রান্তিকালেও আমি দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি আজ নিজেই করোনায় আক্রান্ত। আজ দুদিন যাবৎ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আইসোলেশনে আছি। বাড়িতে ছেলে-মেয়ে, মা-বউ আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় সময় কাটাচ্ছে। তাদের নিয়ে আমারও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কীভাবে চলবে পরিবার? জানি না কবে সুস্থ হবো। কবে আবার পরিবারের কাছে যেতে পারবো, বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে পারবো।
তিনি বলেন, সময়-অসময় নেই জরুরি কল পেলেই দৌড় দিয়েছি। নির্ধারিত স্থানে রোগী পৌঁছে দিয়েছি। যখনই ফোন পেয়েছি সেখানে দ্রুততার সঙ্গে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। সৎভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি। রোগীদের সেবা দেয়াই তো আমার ধর্ম। আমি আমার এই কাজকে অনেক ভালোবাসি তাই অনেক টাকার অফার পেয়েও অন্যত্র যাইনি। রোগী নিয়ে আসলে তারা খুশি হয়ে আমাকে এক-দুইশ টাকা দেন। এটা দিয়েই সংসার চালাই। মানুষের সেবা করেছি এখন মানুষের দোয়া ও আশীর্বাদে ঈশ্বর আমাকে নিশ্চয়ই সুস্থ করবেন।
জানা যায়, সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভপুর উপজেলা ৫০ শয্যা হাসপাতালে ২০১১ সালে এমএনএইচআই’র একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে যোগদান করেন ক্ষিরোদ। ২০১১-১৬ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। পরবর্তীতে প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হলেও তিনি রয়ে যান বিশ্বম্ভরপুরে। কারণ ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার, আর বাবার ভিটে এখানেই। ২০১৭-১৮ সাল বিনা বেতনে কাজ করেছেন দুই বছর। রোগী নিয়ে আসলে খুশি হয়ে যা দিত তা-ই রাখতেন।
পরবর্তীতে উপজেলা পরিষদের মিটিংয়ে রেজুলেশনের মাধ্যমে উপজেলাবাসীর সেবার জন্য নিয়োগ দেয়া হয় ক্ষিরোদকে। বেতন অর্ধেকের চেয়েও কমিয়ে দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, নিয়ম অনুযায়ী উপজেলার সাত ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা এক হাজার করে এবং উপজেলার পরিষদের চেয়ারম্যান দুই হাজার টাকা করে দেবেন। কিন্তু বর্তমানে সেটিও অনিয়মিত। মন চাইলে কখনও তারা টাকা দেন, কখনও দেন না।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ জানান, অ্যাম্বুলেন্স চালকের পদ শূন্য থাকায় টেম্পোরারি (অস্থায়ী) হিসেবে ক্ষিরোদ হাজং কাজ করছে। সে সৎ, নিবেদিত ও কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মী। বর্তমান সংকটেও সে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছে। সংক্রমণের ভীতি থাকা সত্ত্বেও সে সম্মুখসারীর একজন হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে আজ নিজেই করোনায় আক্রান্ত। সে বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইসোলেশনে।
উল্লেখ্য, গত ২৭ এপ্রিল বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার তিনজন স্বাস্থ্যকর্মী (স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, মাঠ কর্মী ও অ্যাম্বুলেন্স চালক) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার রিপোর্ট আসার পর বর্তমানে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স লকডাউন করা হয়েছে। তারা সবাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইসোলেশনে আছেন।
মোসাইদ রাহাত/আরএআর/জেআইএম