গ্রাহকের ১০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও এনজিও
নরসিংদীতে ‘আমরা গড়বো আপনার স্বপ্ন’ স্লোগানে গ্রাহকদের সোনালী স্বপ্নের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে জামায়াত-শিবির ঘরানার আর্থিক প্রতিষ্ঠান আরডিপি ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট।
প্রতিষ্ঠানটিতে তালা ঝুলিয়ে গত ৫ মাস যাবত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় আমানত হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে জেলার প্রায় আড়াই হাজার গ্রাহক। শুক্রবার সকালে প্রতিষ্ঠানটির নরসিংদীর শাখা ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমানকে (৩৫) আটক করেছে বিক্ষুব্দ গ্রাহকরা।
ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহকরা জানায়, নরসিংদী শহরের রাঙামাটি এলাকার কাজী মার্কেটের তৃতীয় তলায় ভাড়া নিয়ে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে শাখার কার্যক্রম শুরু করে আরডিপি ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। পরবর্তীতে জেলার মনোহরদী, রায়পুরা ও মাধবদীতে আরও প্রায় ৩টি শাখা খুলে প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করেন। অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গ্রাহকদের কাছ থেকে মাসিক, দৈনিক ও মেয়াদি আমানত সংগ্রহ করেন। কয়েক বছরের ব্যবধানে এভাবে তারা বিনোয়োগের নামে জেলার ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা আদায় করে। এ দিকে শর্ত অনুযায়ী মুনাফার টাকা না দিতে পারায় তাদের ওপর বিনিয়োগকারীদের চাপ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে গত ১৪ মে কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পালিয়ে যায়।
পুলিশ ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কাজী আবদুল হামিদ নামে এক ব্যক্তিকে আটক করলেও পরে অজ্ঞাত কারণে ছেড়ে দিয়েছে। উল্টো গ্রাহকদের টাকা উদ্ধারের জন্য করা কমিটিতে হামিদকে আহ্বায়ক করা হয়। কিন্তু ৫ মাস পেরিয়ে গেলেও গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত পায়নি। সর্বশেষ আরডিপি কর্তৃপক্ষ চলতি সপ্তাহে জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধের কথা থাকলেও তা রাখেনি।
এই অবস্থায় বিক্ষুব্দ গ্রাহকরা শুক্রবার সকালে গাজীপুরের বুটবাজার এলাকা থেকে নরসিংদীর শাখা ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমানকে আটক করে। পরে তাকে নরসিংদী শহরের রাঙামাটি এলাকায় একটি বাড়িতে আটকে রাখা হয়। খবর পেয়ে প্রতারিত গ্রাহকরা ওই বাড়িতে ভিড় জমায়।
শহরের গাবতলী এলাকার গৃহবধূ শাহিনা আক্তার ২০১২ সালে আরডিপিতে প্রথমে ২ লাখ টাকা জমা রাখেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন ধাপে তিনি নিজে ৩০ লাখ টাকা ও আত্মীয়-স্বজন, ঘনিষ্টদের দিয়ে ৫৬ লাখ টাকা আরডিপিতে জমা রেখেছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ না করে হঠাৎ করে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ায় বিপাকে পড়েছেন দুবাই প্রবাসীর এই স্ত্রী। শাহিনা আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘তারা একের পর এক প্যাকেজ দিয়ে আমাদের মাথা নষ্ট করে টাকাগুলো নিছে। তারা টাকা লুটে চলে গেছে কিন্তু আমার বাড়িতে থাকার অবস্থা নেই।
ওই সময় সদর উপজেলার বাদুয়ারচর গ্রামের ডালিম মিয়া ৪৫ লাখ, কাজী মোশাররফ হোসেনের ১৬ লাখ, কাজী আবদুর রহমানের ৬ লাখ ও নাজমা বেগমের ৮ লাখ টাকা আরডিপি প্রতারণা শিকার হয়েছে বলে জানায়।
সদর উপজেলার চিনিশপুর আবু বক্কর ইসলামীয়া দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বলেন, কাজী মার্কেটের মালিকের ছোট ভাই কাজী আবদুল হামিদ আরডিপির উপদেষ্টা ছিল। ওনি বলেছিলেন, প্রতিষ্ঠানটি শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত, সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী ধার্মিক। তাই ওনার পরামর্শে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ছেলে-মেয়েদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য ৩ লাখ টাকা জমা রেখেছিলাম। কিন্তু ৩ মাসের ব্যবধানেই প্রতিষ্ঠানটি টাকা-পয়সা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। যারা ধর্মের নাম ব্যবহার করে আমাদেরকে হয়রানিতে ফেলেছে, আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছে আমরা তাদের বিচার ও আমাদের টাকা ফেরত চাই।
ক্ষতিগ্রস্থরা জানায়, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খলিল নারায়ণগঞ্জের জেলা শিবিরের সাবেক সভাপতি। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকাংশই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
এই ব্যাপারে জানতে চাইলে কাজী আবদুল হামিদ আরডিপির সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে তিনি নিজেও ক্ষতিগ্রস্থ বলে জানান।
ঘটনার পরই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি গোপনে নরসিংদীতে থাকা তাদের জমি বিক্রি করে দিয়েছে। তবে আটক আরডিপির নরসিংদীর শাখা ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করবে। তবে সেই কথায় আশ্বস্ত হতে নারাজ প্রতারিত গ্রাহকরা। তাকে তাৎক্ষণিক টাকা পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করছে।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, আরডিপি নরসিংদীতে নিবন্ধিত নয়। তাই আইনি জটিলতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
নরসিংদী সদর মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কাশেম বলেন, বেশ কিছুদিন যাবত আরডিপির টাকা নিয়ে জটিলতা চলছে। বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চলছে। তবে ব্যবস্থাপক আটকের খবর তিনি পাননি বলে জানান।
সঞ্জিত সাহা/এমএএস/এমএস