বিনা অপরাধে ২২ বছর ফজলু মিয়ার হাজত বাস
সিলেটে বিনা বিচারে ২২ বছর কারাগারে থাকার পর অবশেষে ফজলু মিয়া সহপাঠির জিম্মায় জামিন পেয়েছেন।
বুধবার দুপুরে সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম জহুরুল হক চৌধুরীর আদালতে ১৯৮তম হাজিরার দিনে তাকে জামিন দেয়া হয়।
এর আগে ফজলুর নিযুক্ত অ্যাডভোকেট জ্যোৎস্না ইসলাম তেতলী ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য ও ফজলুর সহপাঠি কামাল উদ্দিন রাসেলের জিম্মায় জামিন আবেদন করেন।
বেসরকারি সংস্থা ব্লাস্টের সহায়তায় মামলার ধার্য তারিখে আইনজীবী জ্যাৎস্না ইসলাম ফজলু মিয়ার নিজ গ্রামের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য কামাল উদ্দিন রাসেলের জিম্মায় জামিন আবেদন করলে আদালত তাকে জামিন দেন।
১৯৯৩ সালের ১১ জুলাই সিলেট নগরীর কোর্ট পয়েন্ট থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় তাকে আটক করে পুলিশ। পরে পাগল আইন (মানসিক স্বাস্থ্য আইন) এর ১৩ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে জেল হাজতে পাঠানো হয়।
এরপর গত ২২ বছরে দুই বার ফজলু মিয়াকে আদালত জামিন দিলেও কোনো নিকট আত্মীয় খুঁজে না পাওয়ায় তিনি মুক্তি পাননি।
অ্যাডভোকেট জ্যোৎস্না ইসলাম জানান, ফজলু মিয়াকে আসামি হিসেবে নয়, ভিকটিম হিসেবে বিচারকের কাছে তিনি উপস্থাপন করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে বিচারক জামিন মঞ্জুর করেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন পিপি অ্যাডভোকেট সৈয়দ শামিম আহমেদ।
জিম্মাদার কামাল উদ্দিন রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, `দক্ষিণ সুরমার তেতলি এলাকার বাসিন্দা ফজলু মিয়াকে অনেক বছর খুঁজেছি। তিন বছর আগে জানতে পাই তিনি মারা গেছেন। এরপর খোঁজাখুঁজি বন্ধ করে দেই। গত দু’দিন ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফজলুর সংবাদ প্রচার হলে তিনি জীবিত আছেন এ বিষয়ে অবগত হয়ে তার জামিনে আগ্রহী হই।`
ফজলু মিয়ার জীবনের মূল্যবান সময় যারা নষ্ট করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভিতে সম্প্রতি দুই পর্বের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ফজলু মিয়াকে ২২ বছর ধরে পাগল সাজিয়ে জেলে আটক রেখে তার সম্পত্তি আত্মসাৎসহ ফজলুর অসাহায়ত্বের খবর প্রকাশ হলে এটি আলোচনায় উঠে আসে। বিনা দোষে ২২ বছর ধরে কারাবাস, কবে ছাড়া পাবেন ফজলু? শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এরপর টনক নড়ে প্রশাসনের।
অবশেষে বুধবার বিকেল ৫টায় ফজলু মিয়ার জিম্মাদার কামাল উদ্দিন রাসেল ও মুক্তিযোদ্ধা বাদশা মিয়াসহ গ্রামের লোকজন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটক থেকে তাকে গ্রহণ করেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৩ সালের ১১ জুলাই সিলেটের আদালতপাড়া থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে ফজলুকে আটক করেন তৎকালীন ট্রাফিক সার্জেন্ট জাকির হোসেন। সন্দেহের বশে ৫৪ ধারায় ফজলুকে ধরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। তারপর ফজলুর বিরুদ্ধে ‘বাংলাদেশ মানসিক স্বাস্থ্য আইনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ।
পরে ২০০২ সালে ফজলুকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। এই আদেশের পরও কেটে গেছে ১৩টি বছর। কিন্তু কারাগার থেকে তিনি ছাড়া পাননি।
এ প্রসঙ্গে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ছগির মিয়া বলেন, আদালতের নির্দেশ যাই থাক না কেন, আমরা তো গেটের বাইরে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারি না। সমাজসেবা কর্তৃপক্ষ তাদের সেই দায়িত্বটা পালন করতে পারেনি।
আদালতের চোখে কোনো অপরাধ না করেও এ পর্যন্ত অন্তত ১৯৭ বার আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে ফজলুকে। দীর্ঘ এই ২২ বছরে সুরমায় জল গড়িয়েছে অনেক। সরকার বদল হয়েছে কয়েকবার। শহর সিলেট মহানগর হয়ে উঠেছে। পৌরসভা হয়েছে সিটি কর্পোরেশন, তেমনি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা মামলাটি কোতোয়ালি থানার পরিবর্তে চলে গেছে দক্ষিণ সুরমা থানার অধীনে। কিন্তু এতকিছুর পরও ফজলুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের কোনো কূলকিনারা হয়নি।
ফজলুকে ছাড়িয়ে আনতে ২০০৫ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র। কিন্তু তারপরও আইনের মারপ্যাঁচের কারণে কারাগারেই বসবাস করতে হলো ফজলু মিয়ার।
এ বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, যদি তার দোষ খুঁজতে হয়, তার অন্যায় খুঁজতে হয়, এ টুকুই বলতে পারি এ রকম একটা সমাজে ফজলু মিয়া জন্মগ্রহণ করেছে, যে সমাজ এ মানুষগুলোর প্রতি এত অসংবেদনশীল আচরণ করতে পারে।
সময় যতই গড়াচ্ছে, আইনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে ফজলুর কারাবাসের সময় ততই দীর্ঘায়িত হয়েছে। তবে বুধবার ২২ বছর পর ছাড়া পেয়ে মুক্ত আকাশে শ্বাস নিলেন ফজলু।
ছামির মাহমুদ/এমএএস/আরআইপি