করোনায় নয়, মনে হয় মানসিক চাপেই মরে যাব
করোনার ভয়াবহ ছোবল গ্রাস করেছে সারাবিশ্ব। এর হাত থেকে রক্ষা পায়নি বাংলাদেশও। সবকিছু বন্ধ থাকায় মাসের মাঝামাঝি হলেও অনেক ভাড়াটিয়া এখনও তাদের ঘরভাড়া পরিশোধ করতে পারেননি। অন্যদিকে, ভাড়ার টাকার জন্য চাপাচাপি শুরু করেছেন খুলনা নগরীর ভবন/ফ্ল্যাট মালিকরা।
এতে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক ভাড়াটিয়া পরিবার। বাড়ির মালিকের ভয়ে নিম্নবিত্ত পরিবারের আয়ের প্রধান অনেকেই মালিককে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছেন। করোনাভাইরাসের ভয়ঙ্কর থাবায় পুরো বিশ্ব যেখানে থমকে আছে, ঠিক সেই মুহূর্তে বাড়ি ভাড়ার চাপে দিশেহারা খুলনা নগরীর মধ্যবিত্ত, দিনমজুরসহ অনেক ভাড়াটিয়া। এ যেন মরার উপর খড়ার ঘা।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, খুলনা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বসবাস করেন প্রায় ১৬ লাখ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৬০/৭০ ভাগ লোকই অন্যের ঘরে ভাড়ায় থাকেন।
অঘোষিত লকডাউনের প্রভাবে যখন দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট, ঠিক সেই মুহূর্তে বেসরকারি চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দোকান ও বাসা ভাড়ার চাপে ভুলে গেছেন করোনাভাইরাসের কথা। বাধ্য হয়ে অনেকেই রাস্তায় নেমেছে ভাড়া যোগানোর আশায়।
গত দুদিন ধরে খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটিয়া মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
নগরীর ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের মির্জাপুর রোডের ভাড়াটিয়া রাশেদুজ্জামান বাবলু, ইলিয়াস হোসেন, মকবুল আহমেদ, ৩০ নম্বরও ওয়ার্ডের ছোট খালপাড় এলাকার ভাড়াটিয়া রোখসানা খাতুন, কাশেম ফকির, জাহানারা, রাসেল, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের মনিরুল ইসলাম, এস এ খালেক, ফিরোজ সরকারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনাভাইরাসের কারণে দেশব্যাপী চলছে লকডাউন। ফলে অধিকাংশ নিম্ন, মধ্যবিত্তসহ অনেকের ঘরের খাবার শেষ হয়ে গেছে। ত্রাণের আশায় ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন কেউ কেউ। কে কখন ত্রাণ নিয়ে আসেন সেই প্রতীক্ষায়। রয়েছেন চরম বিপাকে। আবার কেউবা লোক লজ্জায় না খেয়েই দিন পার করেন। এ মুহূর্তে বাড়িওয়ালারা ভাড়ার টাকার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছেন।
সোনাডাঙ্গা এলাকার এক ভাড়াটিয়া জানান, বাবার চিকিৎসার জন্য গ্রাম থেকে খুলনায় এসে বাসা ভাড়া নিয়েছেন। তারা কেউ টিউশনি করে, কেউ ক্ষুদ্র চাকরিজীবী। কিন্তু করোনার কারণে চলতি মাসের মাঝখান থেকে তাদের টিউশনি বন্ধ। অন্যজনের চাকরি বর্তমানে বন্ধ। মাস শেষ, বেতন পাওয়া অনিশ্চিত। কিন্তু মাসের প্রথম সপ্তাহেই বাড়িওয়ালা ভাড়ার জন্য বলছে।
নগরীর টুটপাড়া এলাকার রিকশাচালক শহিদুল ইসলাম, কয়রা উপজেলা থেকে আসা নিয়ামত, সবুর, ইদ্রিস জানান, রিকশা চালিয়ে গ্রামে স্ত্রী সন্তানকে টাকা পাঠাতে হয়। বর্তমানে শহরে ঠিকমতো রিকশা চালাতে পারছেন না তারা। ফলে খাবার টাকা জোগাড় করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ঘর ভাড়ার টাকার জন্য বাড়ি মালিক প্রতিদিন বলছে। করোনার ভয়ে বের হওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। বাড়িওয়ালা বাসা ছেড়ে দিতে বলেছে। আর যদি এ বাসায় থাকি তাহলে প্রতিমাসের ১০ তারিখের মধ্যে ভাড়া দিতে হবে বলেছে। সব মিলে মানুসিক চাপের মহাসাগরে আছি, এর থেকে করোনায় মৃত্যু ভালো। করোনায় নয় মনে হয় মানসিক চাপেই মরে যাব এবার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাড়িওয়ালা বলেন, আমরা ঋণ করে বাড়ি করেছি। আজ পর্যন্ত সব টাকা কিস্তি দিতেই যাচ্ছে। একটি টাকা দিয়েও বাজার করে খেতে পারি নাই। আর ব্যাংক তো আমাদের ছাড় দেবে না। এ টাকা তারা নেবেই। সুতরাং বাড়ি ভাড়া ছাড় দেয়া সম্ভব নয়। আর ভাড়াটিয়ারা কোথায় টাকা পাবে এটা চিন্তা করে লাভ নেই। তারা এতদিন চাকরি করে কি করেছে, কোনো টাকা জমায়নি কেন। বিপদের জন্য মানুষ ঠিকই টাকা জমায়। এখন সবার বিপদের সময় টাকা তো দিতেই হবে তাই না।
তবে অনেক বাড়িওয়ালা তাদের ভাড়াটিয়াদের ভাড়ার টাকা পরিশোধ করার জন্য সময় দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
বৃহত্তর খুলনা সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফ উজ্জামান বলেন, যারা বাড়ি ভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন আমি তাদের উদ্দেশ্য বলবো, আপনারা মানবিক হোন। এ দুর্যোগে আপনারাও যোদ্ধা হিসেবে যোগদান করেন।
সবকিছু সরকারের আশায় থাকলে হবে না। নিজেদেরও এগিয়ে আসতে হবে। আপনারা ১ মাসের বাড়ি ভাড়া ছেড়ে দিতে পারেন না। তাই আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ ভাড়াটিয়াদের প্রতি একটু মানবিক হোন। তাদের পাশে দাঁড়ান। আপনারাও করোনা যুদ্ধে যার যার অবস্থান থেকে যোগ দেন। তাহলেই হয়তো আমরা এবারের মতো জয়ী হতে পারবো।
আলমগীর হান্নান/এমএএস/পিআর