করোনায় থমকে গেছে কক্সবাজার
করোনার সংক্রমণ থেকে জেলাবাসীকে রক্ষায় বিগত দু’সপ্তাহ আগে থেকে কক্সবাজার সৈকতসহ পর্যটন স্পটগুলোতে লোকসমাগম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে বন্ধ রয়েছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবসা বাণিজ্য। শুটকি উৎপাদন মৌসুম হলেও সাগরে নামছে না ট্রলার। এতে বন্ধ রয়েছে মাছ আহরণ ও শুটকি উৎপাদন।
পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতর সামনে নিয়ে ফ্যাশন হাউজগুলোতে জমজমাট ব্যবসার আয়োজন থাকার কথা থাকলেও করোনায় এসব ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত উঠেছে। সবমিলিয়ে পর্যটন শিল্প এবং অন্যসব ব্যবসায় জড়িতদের গুনতে হচ্ছে হাজার কোটি টাকা লোকসান। ফলে করোনায় অর্থনৈতিকভাবে দেশের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত জেলা পর্যটন নগরী কক্সবাজার।
হোটেল-মোটেল অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ও হোয়াইট অর্কিড হোটেলের জিএম রিয়াদ ইফতেষার জাগো নিউজকে বলেন, কক্সবাজারে প্রতিবছর দেশি-বিদেশি মিলিয়ে অর্ধকোটি পর্যটক আসেন। তাদের যাতায়াতে প্রতিদিন কয়েকশ দূর-পাল্লার বাস ও ১০-১২টি বিমানের ফ্লাইট আসা যাওয়া করে। পর্যটক সেবায় রয়েছে চার শতাধিক হোটেল-মোটেল ও কটেজ এবং কয়েকশ রেস্তোরাঁ।
সমুদ্র ভ্রমণ আরামদায়ক করতে কাজ করে শতাধিক ট্যুরিজম। বিনোদনের জন্য রয়েছে নানা পর্যটন স্পট। ভ্রমণের মুহূর্ত ফ্রেমে বন্দি করে রাখতে কাজ করে তিন শতাধিক ক্যামেরাম্যান। রয়েছে শামুক-ঝিনুকের পণ্য বিক্রির হাজারো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
তার মতে, করোনার প্রভাবে গত ১৫ দিন ধরে বন্ধ পর্যটন ব্যবসা। ধরে নেয়া যায় এটি ঈদুল ফিতরের আগের দিন পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। সেই হিসেবে বন্ধ দাঁড়ায় প্রায়ই ২ দুই মাস। ব্যবসা বন্ধ থাকায় বাস, প্লেন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্যুর অপারেটর, ফটোগ্রাফার এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট সকল খাতে দৈনিক ২৫-৩০ কোটি টাকার লেনদেন বন্ধ রয়েছে। সেই হিসাবে দুই মাসে বন্ধ থাকবে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকার লেনদেন।
কক্সবাজার গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার জাগো নিউজকে বলেন, ব্যবসা বন্ধ থাকলেও মেইনটেনেন্স খরচ গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, পরিচ্ছন্নতা, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন বিলসহ নানা খাতে ক্যাটাগরি অনুসারে একেক হোটেল মালিককে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। সেই হিসাবে ব্যবসা বন্ধ প্রায় দু’মাসে ৪শ হোটেল-মোটেল-কটেজ এবং রেস্তোরাঁ মালিককে কমপক্ষে অর্ধশত কোটি টাকা লোকসান দিতে হবে। এর সঙ্গে রয়েছে ব্যাংকঋণের সুদও।
ট্যুরস অপারেটর অনার্স এসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) এর সূত্রমতে, জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোতে পর্যটকদের যাতায়াত সহজতর করতে ট্যুর সংশ্লিষ্টরা কাজ করে। সবার অফিস ও কর্মচারী রয়েছে। ব্যবসা বন্ধ থাকলেও অফিস ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল এবং কর্মচারীদের বেতন বাবদ অনেককে মাসে অর্ধলাখ টাকা গুনতে হবে। করোনা প্রভাবের দু’মাসে ট্যুরিজম ব্যবসায়ীদের লোকসান হবে প্রায় এক কোটি টাকা। এভাবে পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব খাত মিলিয়ে দুইমাসে প্রায় ৫শ কোটি টাকার মতো লোকসান গুনবে।
এদিকে নাজিরারটেক শুটকি উৎপাদন মালিক সমিতির সভাপতির আতিকুর উল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, শুটকি উৎপাদন মৌসুম চললেও শুটকি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তবে,ছুরি-লইট্টা-পোয়া এবং পাঁচ মিশালিসহ অনেক ধরনের মাছ মিলিয়ে ৬ হাজার মেট্রিকটন মাছ শুকানো রয়েছে। সাগরে ট্রলার কম যাওয়ায় এখন শতকরা ৬০-৭০ ভাগ মাছ শুকানো কমে গেছে। গুদাম শুকনো মাছে ভরা থাকলেও চাহিদা না থাকায় মাছ পাঠাতে পারছি না। যদি আরও এক সপ্তাহ মাছ রফতানি বন্ধ থাকে তবে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের শত কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস.এম খালেকুজাম্মানের মতে, জেলেরা করোনার ভয়ে মাছ আহরণে যাচ্ছে না। তাই মাছ শুকানো হচ্ছে গত বছরের তুলনায় ৪০ ভাগ কম। এছাড়া প্রায় প্রত্যেকের গুদামেই মাছ মজুদ রয়েছে। পাশপাশি মাছ সরবরাহ না থাকায় কাঁচা মাছের বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। লোকসান হিসাব করা সম্ভব কোয়ারেন্টাইন শেষ হলেই। এর আগে এর হিসাব করার সুযোগ আমাদের নেই।
শুধু পর্যটন ও মৎস্য শিল্পে নয়, করোনার লোকসান গুনতে হচ্ছে কাপড়, জুতাসহ নানা পণ্য ব্যবসায়ীদেরও। এ বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি কক্সবাজার জেলা সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম মুকুল জাগো নিউজকে বলেন, সামনে বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ। গত বছর এ সময়ে জেলায় প্রায়ই শত কোটি টাকার বস্ত্র ও জুতা বিকিকিনি হয়েছে। কিন্তু এবার করোনায় দোকান পর্যন্ত বন্ধ। জেলার দোকানদাররা এবার কমপক্ষে ২০-২৫ কোটি টাকা লোকসান গুনবে। ঈদ পর্যন্ত এ অবস্থা বিরাজ থাকলে লোকসান কয়েকশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ'র সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, করোনা বিশ্ব অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। পর্যটন জেলা হিসেবে কক্সবাজার সেই ক্ষতির ধাক্কায় পড়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এটি কাটানোর পন্থা খোঁজার প্রচেষ্টা চালানো হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সায়ীদ আলমগীর/এমএএস/জেআইএম