ডাক্তারের উদ্যোগ দেখে মাঠে নেমেছেন রিকশাচালক রমজান

মাহাবুর আলম সোহাগ
মাহাবুর আলম সোহাগ মাহাবুর আলম সোহাগ , সহকারী বার্তা সম্পাদক (কান্ট্রি ইনচার্জ)
প্রকাশিত: ০৭:০৩ পিএম, ১৩ মার্চ ২০২০

সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ে এক নারীর মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছেন তার স্বামী। স্ত্রীকে অসামাজিক কাজে যুক্ত করে টাকা আয় করতে চেয়েছিলেন তিনি (স্বামী)। কিন্তু ওই নারী অনৈতিক এ কাজে সম্মতি না দেয়ায় পাষণ্ড স্বামী তার মাথার সব চুল কেটে দিয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশ পাষণ্ড ওই ব্যক্তিকে আটক করেছে।

এছাড়াও বিভিন্ন সময় স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নির্যাতন এবং হত্যার ঘটনা অহরহ ঘটছে আমাদের দেশে। বিশেষ করে যৌতুকের ক্ষেত্রে এসব ঘটনা ঘটছে বেশি। চারপাশে যখন এমন অমানবিক ঘটনা ঘটছে ঠিক ওই সময় এক রিকশাচালক তার অসুস্থ স্ত্রীকে বাঁচাতে ছুটছেন দিগ্বিদিক।

পাঁচ মাস ধরে রমজান আলী নামের এ রিকশাচালক বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা তুলে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত স্ত্রীর পাঁচটি কেমো থেরাপি সম্পন্ন করেছেন। আর মাত্র একটি থেরাপি বাকি। সেটি দেয়া হবে আগামী ২৩ মার্চ। এ থেরাপি দেয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রিপোর্ট ভালো হলেই হবে অপারেশন। প্রতিটি থেরাপি দিতে সব কিছু মিলে খরচ হচ্ছে ১৮ হাজার ৭৬০ টাকা। এর মধ্যে প্রতিটিতে ৩ হাজার টাকা করে সহযোগিতা করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. আলিয়া শাহনাজ। তার অধীনেই চিকিৎসা নিচ্ছেন রমজান আলীর স্ত্রী মনি বেগম (৩৭)

রমজান আলীর বাড়ি নাটোর সদর উপজেলার ৫নং বড়হরিশপুর ইউনিয়নের কামারদিয়া (রাজাপুর) গ্রামে। ১৫-১৬ বছর আগে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। বর্তমানে থাকেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ের উত্তরগরান আদর্শবাগ এলাকায়।

লোকমুখে শুনে অনেক ভরসা নিয়ে কিছুদিন আগে জাগো নিউজের কার্যালয়ে আসেন রমজান আলী। বিশ্বাস অর্জনে সঙ্গে আনেন স্ত্রীর প্রেসক্রিপশনসহ চিকিৎসার যাবতীয় কাগজপত্র।

তিনি জানান, স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ছুটোছুটি করতে গিয়ে ছয় মাস ধরে নিয়মিত রিকশা চালানো হয় না। এ কারণে তার আয় রোজগার কমে গেছে। তারপরও প্রতি মাসে স্ত্রীর পেছনে চিকিৎসা বাবদ খরচ হচ্ছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। এছাড়া সংসার খরচ তো রয়েছেই। পরিবারে ৭ বছরের এক ছেলে ও ১৮ বছরের এক মেয়ে রয়েছে। খিলগাঁওয়ে এক রুমের যে বাসায় তিনি থাকেন সেটির ভাড়া ৫ হাজার টাকা। স্ত্রী ও মেয়ে থাকে ঘরে। তিনি ছেলেকে নিয়ে থাকেন বারান্দায়।

মেয়ে সুরাইয়া ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর অভাবে আর এগোতে পারেনি। এখন এলাকায় একটি কোম্পানিতে ৭ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে। তার বেতনের টাকায় মূলত চলছে সংসার।

রমজান আলী বলেন, গত বছরের মে মাসে স্ত্রীর ক্যান্সার ধরা পড়ে। অনেকের পরামর্শে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগে নিয়ে যাই। সেখানে ডা. আলিয়া শাহনাজ তার (স্ত্রী) চিকিৎসা শুরু করেন। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনিও নিশ্চিত করলেন ক্যান্সার হয়েছে। তিনি জানান, ছয়টি কেমো থেরাপি দিতে হবে। সেগুলো ২১ দিন পর পর। আমার আর্থিক অবস্থা দেখে জানালেন প্রতিটি কেমো থেরাপিতে তিনি ৩ হাজার করে টাকা সহযোগিতা করবেন। তার এ উদারতা সেদিন আমাকে মুগ্ধ করেছে। তার দেয়া সাহস ও সহযোগিতায় মূলত আমার স্ত্রীর কেমো শুরু করতে পেরেছিলাম। তা না হলে হয়তো পারতাম না।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত পাঁচটা কেমো দেয়া হয়েছে। একটা বাকি রয়েছে। এটা এ মাসেই দিতে হবে। সবগুলো কেমো দেয়ার পর আবারও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। রিপোর্ট ভালো হলে অপারেশন। এতে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হবে। প্রতিটি কেমোর টাকা জোগাড় করতে কি পরিমাণ কষ্ট হয়েছে তা বলে বোঝাতে পারবো না। এ পর্যন্ত স্ত্রীর চিকিৎসায় প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ হাজার টাকা বিভিন্নজনের কাছ থেকে সহযোগিতা হিসেবে পাওয়া। বাকি টাকা রিকশা চালিয়ে ও ধারদেনা করা।

cancer

তিনি আরও বলেন, কিছু কিছু ডাক্তারের কারণে তাদের সম্পর্কে সব সময় একটা নেতিবাচক ধারণা কাজ করছিল। কিন্তু সেটা দূর হয়েছে ডা. আলিয়া শাহনাজের উদারতায়।

রমজান বলেন, অভাবের কারণে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা দেখানোর সুযোগ কখনও হয়নি। চিকিৎসা শুরুর আগেও হয়নি। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর ডাক্তার যখন নিজে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন তখন অবাক হলাম। ভাবলাম, উনি একজন রোগীকে বাঁচাতে যদি এমন উদ্যোগ নিতে পারে তাহলে আমি রোগীর এত আপনজন হয়েও তাকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিতে পারবো না কেন? তখনই উদ্যোগ নিলাম যেকোনো উপায়ে আমার স্ত্রীর চিকিৎসা করাবো, তাকে বাঁচাবোই।

তিনি বলেন, যখনই রিকশায় কোনো যাত্রী ওঠেন তখন তাদের আমার স্ত্রীর ক্যান্সারের বিষয়টা বুঝিয়ে বলি। যারা বিশ্বাস করে তারা ভাড়ার পাশাপাশি বাড়তি সহযোগিতাও করেন। অনেকে আবার বিশ্বাস করেন না। তারা সহযোগিতাও করেন না। এভাবেই কিছু টাকা সংগ্রহ করে এতদূর চিকিৎসা করাতে পেরেছি। আরেকটা কেমো দেয়ার পর অপারেশন। তখন এক লাখ টাকা প্রয়োজন। কোথায় পাব এত টাকা? কে করবে সহযোগিতা?

রমজান বলেন, মাঝে মধ্যেই শুনি এবং দেখি সমাজের হৃদয়বান মানুষগুলো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়। সেই ভরসায় জাগো নিউজের অফিসের এসেছি। তিনি বলেন, কেউ কি আমার পাশে দাঁড়াবেন? আমার স্ত্রীকে বাঁচাতে কেউ সহযোগিতা করবেন? তার চিকিৎসায় অনেক দূর হেঁটেছি। আর পারছি না। দয়া করে আমার এ উদ্যোগে কেউ পাশে দাঁড়ান।

রিকশাচালক রমজান আলীর বিষয়টি অধিকতর যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নের মাধ্যমে খুঁজে বের করা হয় তার এলাকার ইউপি সদস্যকে। তথ্য বাতায়নের নাটোর জেলা পেজটি নিয়মিত আপডেট না করায় সদর উপজেলার ৫নং বড়হরিসপুর ইউনিয়নের কামারদিয়া গ্রামের ইউপি সদস্য বোরহান উদ্দিন খানের নাম আপডেট করা হলেও মোবাইল নম্বরটি রয়ে গেছে সাবেক ইউপি সদস্য হোসেন আলীর।

কথা হয় হোসেন আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, রমজানের স্ত্রীর ক্যান্সার ধরা পড়ার পর আমরা এলাকা থেকেও তাকে কিছু সহযোগিতা করেছি। ১৫ বছর আগে সে ঢাকায় চলে গেছে। এলাকায় তার আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। সে মাঝে মধ্যে এলাকায় আসে। এ প্রতিবেদকের কাছে বিস্তারিত শুনে তিনি সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

আসুন না একজন অসহায় মানুষকে তার স্ত্রীকে বাঁচানোর যুদ্ধে সহযোগিতা করি। আমাদের ছোট একটি অংশগ্রহণে বাঁচতে পারে কারও প্রাণ। রমজান আলীর সঙ্গে কথা বলা যাবে ০১৭৬২-০৪৩২২৫ নম্বরে। তার যুদ্ধে শরিক হতে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে টাকা পাঠানো যাবে এ নম্বরেই।

সতর্কতা : যেকোনো মানবিক সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর একটি প্রতারক চক্র ভুক্তভোগী পরিবারটিকে ফোন করে জানায়, তিনি সমাজসেবা মন্ত্রণালয় থেকে বলছেন। এ সংবাদ দেখার পর সরকার ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। সেই টাকা তুলতে বিকাশে টাকা চেয়ে থাকেন প্রতারক চক্রটি। নিজ দায়িত্বে চক্রটির ফাঁদ থেকে দূরে থাকুন।

এমএএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।