এখনো ভয়ে আঁতকে উঠি
সেই দিনের কথা মনে হলে আমি আজও ভয়ে আঁতকে উঠি। গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে। স্বপ্নে দেখি যুদ্ধ করছি। যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের মরদেহগুলো পড়ে আছে। মনে শান্তি পায় যে দেশের জন্য কিছুটা হলেও করতে পেরেছি।
৭ অক্টোবর ১৯৭১ সালে নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার ঐতিহাসিক পাহাড়পুরে সম্মুখ যুদ্ধ। মানুষকে সমৃদ্ধ রাখার নিজের জীবনকে বিসর্জন দিয়ে ওইদিন পাহাড়পুরে দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত যুদ্ধ করেছি। সেদিন কমপক্ষে একশ কয়েকজন মিলিটারি মারা যায়। আমার সহযোগী শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলু, আফজাল, ফরিদ, আসির ও গণি শহীদ হন।
ওইদিন যুদ্ধ যখন শেষের দিকে তখন দেখি কোনো শব্দ নাই। শব্দ না থাকায় পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখি ৪ জন মিলিটারি গাড়ি চড়ে আমার দিকে আসছে। দূরত্ব প্রায় দেড়শ ফুট। সঙ্গে যোদ্ধা আবুল ভাই ছিলেন। মিলিটারিরা গুলি করলে তিনি মারা যায়। তখন সুযোগ বুঝে আমি সেখান থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। একটি ধান ক্ষেতে লুকিয়ে পড়ি।
অপরদিক থেকে মিলিটারির অন্য একটি দল ধান ক্ষেতের আইল দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমাকে দেখতে পেয়ে ডাক দেয়। এই রাজাকার দাঁড়া। সঙ্গে একটি মাত্র গ্রেনেড ছিল। পিন পরিষ্কার করে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিছু হলেই গ্রেনেডটা ছুঁড়ে দিব। আর লা ইলাহা ইলা আন্তা সুবহানাকা বলে আল্লাহ আল্লাহ করতেছি। দেখলাম পরে আর কাঁদার মধ্যে মিলিটারি না এসে চলে গেল।
জয়পুরহাট জেলা ইউনিট কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল ইসলাম (৬১) এর সঙ্গে গত ৭ অক্টোবর ঐতিহাসিক পাহাড়পুর যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে এক সাক্ষাতের সময় তিনি কথাগুলো বলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর (৩ মাস) যুদ্ধ করেছিলন। তিন মাস যুদ্ধে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে জয়পুরহাট এবং ১২ ডিসেম্বর আক্কেলপুর মুক্ত হয়।
এছাড়া আমাদের কাছে খবর আসল যে ১০ ডিসেম্বর মিলিটারি বাহিনী বদলগাছী থানায় আশ্রয় নিয়েছে। আমরা থানায় আক্রমণ করলে দু’পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারপর বদলগাছী থানা ভেঙে দেয়া হয়। সেখানে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সে সময় আমার পিছনের দিকে একটা গুলি লেগেছিল।
সংক্ষিপ্ত পরিচয় :
আজিজুল ইসলাম জয়পুরহাট জেলা ইউনিট কমান্ডার ও জয়পুরহাট জেলা ক্রীড়া সম্পাদক। তার বাড়ি জয়পুরহাট সদরে সাহেবপাড়া এলাকায়। তিনি জয়পুহাট সুগারমিলে চাকরি করেন। স্ত্রী জয়পুরহাট পৌরসভার হাতিল মাগনিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে আসা :
তখন আমার বয়স ১৫ বছর হবে। এসএসসি পরীক্ষার জন্য আক্কেলপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ফরম পূরণ করেছি। ফরম পূরণ করার পর যুদ্ধ শুরু হলে আর পরীক্ষা দেয়া হলো না।
এদিকে, প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য জয়পুরহাটের আক্কেলপুর বিখ্যাত ছিল। দেখেছি বাংলাদেশে ৬ দফার জন্য ১৯৬২/ ৬৫ /৬৮ সালে আন্দোলন করতে। ১৯৭১ সালে সাড়ে ৭ কোটি নিরহ বাঙালির উপর নির্যাতন করা হয়েছে। বাড়িতে থাকলেও রাজাকার, স্টেশন থাকলেও নির্যাতন। মরলে দেশের জন্য মরব পালিয়ে যাব কেন। দেশের ভালবাসার তাগিদে দেশের মানুষকে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে যুদ্ধ করেছি।
প্রশিক্ষণ :
ভারত থেকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষ করে অস্ত্রপাতি নিয়ে প্রথমে পাহাড়পুরে চলে আসি। ১৯৭১ সালে ৭ অক্টোবর নওগাঁর পাহাড়পুরে যুদ্ধ করেছি। আমাদের গ্রুপে ফজলু, আফজাল, ফরিদ, আসির, গণি ও শরিফ, শহীদসহ ২১/২৫জন ছিলাম। ভারতের মধুপুর আব্দুল জলিলের ক্যাম্পে প্রথম ট্রেনিং করি। ২/৩ দিন পর আমি হায়ার ট্রেনিংয়ে জন্য শিলিগুড়িতে চলে যায়। সেখানে থেকে পতিরামপুর। রাতে দেখি ম্যাট্রিক পাশ ছাত্রলীগ যারা করে তাদের কে ডাকতেছে। মুজিব বাহিনী গঠন করার জন্য। আমি ম্যাট্রিক পাস না বলে আমাকে সেখানে নেয়া হলো না।
শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি স্মৃতিফলক নির্মাণের দাবি জানান তিনি। এছাড়া যখন মুক্তিযোদ্ধের সময় ট্রনিং করেছিলাম তখন ছবিসহ নাম তালিকা করা হয়েছিল। সে তালিকায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম পাওয়া যাবে। যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আছে তাদের সনাক্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান।
আব্বাস আলী/এসএস/এমএস