ইলিশে নিষেধাজ্ঞা : বসেছিল বাংলাদেশি জেলেরা, মাছ ধরেছে ভারতীয়রা
বঙ্গোপসাগরসহ উপকূলের সর্বত্র এখন ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। এসময় একটি মা ইলিশ বেঁচে থাকলে জন্ম নেবে হাজারও ইলিশ। তাই ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপকূলীয় নদ-নদী ও বঙ্গোপসাগরে ২৫ সেপ্টেম্বর হতে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১৫ দিন ইলিশ শিকার নিষিদ্ধ করেছিল সরকার।
এদিকে ১৫ দিন পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় ৯ অক্টোবর শুক্রবার ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে সরকার।
ভুক্তভোগী জেলেদের অভিযোগ, বাংলাদেশি জেলেরা নিষেধাজ্ঞা মেনে ইলিশ শিকার থেকে বিরত থাকলেও এ সুযোগে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে নির্বিঘ্নে ইলিশ শিকার করে করেছে ভারতীয় জেলেরা।
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জাগো নিউজকে জানান, মৎস্য গবেষকরা আশ্বিন মাসের মধু পূর্ণিমার আগের তিনদিন থেকে পরবর্তী ১৫ দিন মা ইলিশের সর্বোচ্চ প্রজননকাল চিহ্নিত করেছেন। তাই এ বছরই প্রথম ১১দিনের পরিবর্তে ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞার সময় সীমা ১৫ দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল। শুধু আহরণই নয়, ইলিশ সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিপণন এ সময় নিষিদ্ধ করা হয়।
তিনি বলেন, ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৩ সাল থেকে এ সময়ে উপকূলীয় নদ-নদী ও সাগর মোহনায় ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আসছে বাংলাদেশ সরকার।
গোলাম মোস্তফা চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, ইলিশ শিকারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশি জেলেরা মানলেও মায়ানমার ও ভারতীয় জেলেরা এসব নিসেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধ অনুপ্রবেশ করে নির্বিঘ্নে মাছ শিকার করেছে এবং এখনো করছে। এতে প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সংরক্ষণ ও নিরাপদ প্রজননে বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশ্য ভেস্তে যাচ্ছে। এ সময়ে ভারতীয় জেলেদের বাংলাদেশের জল সীমায় অনুপ্রবেশ করে ইলিশ শিকার বন্ধে কার্যকর ভূমিকার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, মা ইলিশ সংরক্ষণে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভারতের মধ্যে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল মান্নান জানান, একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি সুদীর্ঘ বছরের জলদস্যু সমস্যা তো রয়েছেই। তার উপরে গত কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে ভিনদেশি ট্রলি ও ট্রলারের অত্যাচার। এত সমস্যার বেড়াজালে দেশীয় জেলেরা আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, এসব নানা কারণে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছেন রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে। গ্রামের শিতল আবাস ছেড়ে তাদের ঠাঁই হয়েছে ইট-পাথরের ব্যস্ত ফুটপাতে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর একটি অভিযানে বেশ কিছু ভারতীয় মাছ ধরার ট্রলার ও জেলেদের আটক করা গেলেও বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ জলসীমায় এখনও শত শত ভারতীয় ট্রলার নির্বিঘ্নে ইলিশ শিকার করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী বাংলাদেশি জেলেদের।
জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার শ্রমিক নেতা আব্দুল মান্নান জানান, গভীর সাগরে প্রতিদিন ভারতীয় এবং মায়ানমারের শত শত স্বয়ংক্রিয় মৎস্য শিকারি ট্রলার নির্বিঘ্নি ইলিশ শিকার করে যাচ্ছে। শুধু ইলিশ প্রজনন মৌসুমেই নয়, বছর জুড়েই বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ সীমানায় চলে এসব বিদেশি ট্রলারের রামরাজত্ব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর ২ দিন বাংলাদেশ নৌবাহিনী সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে অভিযান চালিয়ে ১৩টি মাছ ধরা ট্রলারসহ ১৬৫ জন ভারতীয় জেলেকে আটক করে। এ সময় ট্রলারে তল্লাশি চালিয়ে ৩শ মন মা ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৭শ ৫০ মণ মাছ জব্দ করা হয়।
এদিকে ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে দক্ষিণ উপকূলের অন্তত ৫০ হাজার জেলে ১৫ দিনের জন্য বেকার হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ মৎস উন্নয়ন কর্পোরেশন পরিচালিত পাথরঘাটার দু’টি পাইকারি বাজার (পাথরঘাটা ও চরদুয়ানী) বন্ধ থাকায় বেকার হয়ে পড়েছে শত শত শ্রমিক। ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। ইলিশ প্রজনন মৌসুমে প্রান্তিক জেলে ও মৎস্য শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান কিংবা কোনোরূপ পূণর্বাসন সহায়তার ব্যবস্থা না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় জেলেরা।
এ বিষয়ে বরগুনা ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা আলফাজ উদ্দিন শেখ জানান, ভারতীয় জেলেদের আগ্রাসনের বিষয়টি নিয়ে এর আগেও জেলার মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক ও শ্রমিকরা একাধিকবার মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপিও দিয়েছেন। প্রজনন জেলেদের পূনর্বাস সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জেলেদের এ দাবির বিষয়ে অবগত হয়েছেন।
এমএএস/এমএস