৩৩ শীর্ষ জঙ্গি গ্রেফতার করা পুলিশ কর্মকর্তা ঘুরছেন পথে পথে
একজন গর্বিত পুলিশ অফিসার হওয়ার ব্রত নিয়ে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন শফিকুল ইসলাম সাজু। অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ঠিক পথেই এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু কপালে সুখের দেখা মেলেনি। দেশ মাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করে যে মানুষটি প্রথম জঙ্গি অভিযানে অংশ নিয়ে ৩৩ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করেন আজ তার ভাগ্যে কেবলই লাঞ্ছনা।
বাংলাদেশের প্রথম ৩৩ জন শীর্ষ জঙ্গি গ্রেফতার ও মামলার বাদী শফিকুল ইসলাম সাজুকে পুরস্কারের বদলে চাকরিচ্যুত করা হয়।ফলে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে শতবর্ষী মা, স্ত্রী ও স্কুল-কলেজপড়ুয়া সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন এক সময়ের সাহসী পুলিশ অফিসার শফিকুল ইসলাম সাজু।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ইমাদপুর ইউনিয়নের ইমাদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শফিকুল। ছয় ভাই ও চার বোনের মধ্যে অষ্টম সন্তান শফিকুল ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন বড় হয়ে দেশের জন্য কিছু করার। সেই ব্রত নিয়ে ১৯৯৬ সালের ১ জানুয়ারি জয়পুরহাটে পুলিশ বাহিনীতে যোগদানও করেন।
জানতে চাইলে সাবেক এ পুলিশ কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ২০০৩ সালের ১৫ আগস্ট জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল থানায় কর্মরত অবস্থায় ওইদিন রাতে ওসি ইকবাল শফির নেতৃত্বে এক দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নেন তিনি। জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর বন্দুকযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বহুল আলোচিত সিদ্দিকুর রহমান বাংলাভাই, শায়েখ আব্দুর রহমানের জামাতা আব্দুল আউয়াল, শীর্ষ জঙ্গি নেতা আতাউর রহমান সানি, ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের ভ্যান থেকে পালিয়ে যাওয়া আসামি সালাউদ্দিন সালেহীন ও বাংলাভাইয়ের দেহরক্ষী মামুনুর রশীদসহ ৩৩ জনকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতার অভিযানই যেন কাল হয়ে ওঠে জীবনে। রোষানলে পড়েন তৎকালীন মন্ত্রী, এমপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের।
অভিযান শেষে ক্ষেতলাল থানায় ফিরে এসআই শফিকুল ইসলাম সাজু বাদী হয়ে মামলা করেন। যদিও গ্রেফতারদের অনেকে ছাড়া পান এবং পরে আবারও গ্রেফতার হন। ঘটনাটি ওই সময় সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও কয়েক দিনের প্রেক্ষাপট বদলে যায়। প্রথমে অস্ত্র হারানোর অপরাধে দুজন কনস্টেবলকে চাকরিচ্যুত করা হয়, কিন্তু তারা বিশেষ জেলার লোক হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই চাকরি ফিরে পান।
অন্যদিকে ওসি ইকবাল শফির ওয়াকিটকি হারানোর অপরাধে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হলেও তা থেকে তিনিও খালাস পান। অথচ সব কৃতিত্বের দাবিদার এসআই সাজুকে কয়েক দিনের মধ্যেই বদলি করা হয়।
ওই ঘটনায় বিভাগীয় মামলার দণ্ড হিসেবে ব্ল্যাকমার্ক দিয়ে তাকে ঢাকা মেট্রোপলিটনে বদলি করা হয়। ফলে ডিএমপিতে ঊর্ধ্বতন পুলিশের কাছে অপরাধী থেকে যান এসআই সাজু।
মিরপুর থানায় কর্মরত থাকা অবস্থায় ওসি ইন্তেজার রহমান (যিনি ঢাকাস্থ বগুড়া সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন) নানাভাবে তাকে হয়রানির চেষ্টা করেন। অবশেষে জমি নিয়ে দু’পক্ষের বিরোধের ঘটনায় সাজুুর নাম যুক্ত করে দেয়া হয়। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।
তৎকালীন (ডিসি) কোহিনূর মিয়া শফিকুল ইসলাম সাজুর বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করে দেন এবং ২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর তাকে চূূড়ান্তভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় মানবেতর জীবন।
শফিকুল ইসলাম সাজু জানান, তিনি ডিএমপি পুলিশ কমিশনার বরাবর আপিল করেন। যার মাধ্যমে আপিল করতে হয় তিনি ছিলেন ইন্তেজারের পরম বন্ধু ইউনুস আলী (ওসি)। ফলে আপিলের সাজা মওকুফ না করে বরং তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
বড় ছেলে গত বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। অর্থাভাবে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেনি। ছোট ছেলে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে কোনোরকমে ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন সাজু। কিছুদিন একটি স্কুলের ব্যবস্থাপনা পর্ষদে কর্মরত থাকলেও আট মাস ধরে বেকার।
শফিকুল বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযানে ৩৩ জন শীর্ষ জঙ্গিকে গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলার বাদী হওয়ায় তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেদিন জীবন বাজি রেখে শীর্ষ জেএমবি নেতাদের না ধরলে আজ আমার পরিবার-পরিজন নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হতো না।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ক্ষতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারীরা আবেদন করলে সরকার রিভিউ করে ক্ষতি পুষিয়ে দেবে। সে অনুযায়ী রিভিউ আবেদন করলেও আজ পর্যন্ত সুফল পাইনি। তবে তার আবেদনটি খারিজও হয়নি, যা এখন পর্যন্ত মুলতবি আছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এমএএস/পিআর