‘করোনাভাইরাস’ নিয়ে কাস্টমস কমিশনের এ কেমন পোস্ট!
ভারত থেকে আসা কলকাতা-খুলনাগামী বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেনে বাংলাদেশি এক পাসপোর্টযাত্রী ‘করোনাভাইরাসে’ শনাক্ত হয়েছেন- নিজ ফেসবুক পেজে এমন স্ট্যাটাস দেন বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার বেলাল হোসাইন চৌধুরী। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।
‘করোনাভাইরাস’ নিয়ে কোনো ধরনের গুজব ছড়ানোসহ আক্রান্ত ব্যক্তির ছবি কিংবা পরিচয় প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপ থাকলেও একটি দায়িত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে এ ধরনের পোস্ট কীভাবে দেয়া হলো— এ বিষয়ে কাস্টমম কমিশনার বেলাল হোসাইন চৌধুরীর বক্তব্য, ‘ওটা তো ডিলিট করে দিয়েছি। মূল পোস্ট ডিলিট হয়ে গেছে। মূলত সচেতনতা বাড়াতে এমন পোস্ট দেয়া।’
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানো প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা চলছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে একশ্রেণির মানুষ গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছে। মুরগির মাংস খাওয়া, মাস্ক ব্যবহার করা থেকে শুরু করে বিদেশফেরত সুস্থ মানুষকে নিয়েও গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
করোনাভাইরাস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানো প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট- আইইডিসিআর বলছে, গুজব ছড়ালে এ ভাইরাস মোকাবিলায় বাধা সৃষ্টি করবে।
ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এ ভাইরাস নিয়ে দেশ-বিদেশের খবরের বরাত দিয়ে নানা গুজব সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাতে রোগী শনাক্ত করাও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। গুজবের পরিণতিতে সাতক্ষীরায় একজন সন্দেহজনক রোগীর মায়ের দুঃখজনক মৃত্যু ঘটেছে। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো জায়গায় স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। চীন ও সিঙ্গাপুর ফেরত কোনো কোনো যাত্রীর ব্যক্তিগত ও সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
গুজবে প্রভাবিত হয়ে অনেক জায়গায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চীন এবং সিঙ্গাপুর ফেরত যাত্রীদের সঙ্গে ‘জবরদস্তিমূলক আচরণ’ করছে বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক ফ্লোরা। তিনি বলেন, ‘গুজব এবং জবরদস্তি সম্ভাব্য রোগী শনাক্তে বাধা তৈরি করবে। এতে সন্দেহজনক রোগীরা তথ্য ও অবস্থান গোপন করবে। এটা রোগী শনাক্তের চেষ্টাকে হুমকির মুখে ফেলবে।’
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় বেনাপোল কাস্টমম কমিশনার বেলাল হোসাইন চৌধুরী তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন, ‘করোনাভাইরাসে’ আক্রান্ত বাংলাদেশি এক পাসপোর্টযাত্রী বেনাপোল রেলস্টেশনে শনাক্ত হয়েছেন।’ তাৎক্ষণিক কাস্টমসের সহকারী কমিশনার উত্তম চাকমা ও আকরাম হোসেন বিষয়টি যশোর সিভিল সার্জন অফিস ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে অবহিত করেন।
‘করোনাভাইরাসের’ গুজব ওঠা ওই পাসপোর্টযাত্রীকে হেফাজতে নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় বেনাপোল ও শার্শার মেডিকেল টিম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। পর তার শরীরে করোনাভাইরাসের কোনো লক্ষণ পাওয়া না যাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।
শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক আজিম উদ্দিন বলেন, ‘এ ধরনের সংবাদে আমরা দুজনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। তাদের শরীরে এ ধরনের কোনো ভাইরাসের সিমটম পাওয়া যায়নি। এরপর আমরা ঢাকায় উচ্চপর্যায় কথা বলে তাদের ছেড়ে দেই।’ ওই দুজন ব্যবসায়ী। তারা চীনের সঙ্গে ব্যবসা করে। প্রায় ২৫ দিন আগে তারা চীন থেকে বাংলাদেশে আসে।
কিন্তু নিশ্চিত না হয়েই বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার বেলাল হোসাইন চৌধুরী ফেসবুকে ‘করোনাভাইরাসে’র বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং তাদের পরিচয়ও জানান। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, “ভারত থেকে আসা ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’ থেকে একজন ‘করোনাভাইরাসে’র রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা রেলের নিয়মিত দায়িত্ব পালনকালে একজন বিশ্বস্ত সূত্রে গোপন সংবাদ পায় এবং রোগীকে শনাক্ত করে। তাৎক্ষণিক এসি উত্তম চাকমা ও আকরাম হোসেন বিষয়টি যশোর সিভিল সার্জন অফিস ও উপজেলা স্বাস্থ্য অফিসকে জানায় এবং সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও নজরে আনে! শনাক্তকৃত রোগীর নাম….। বাড়ি…। তিনি চীন থেকে ভারতে আসেন! ভারতীয়রা বিষয়টি সম্ভবত বুঝতে পেরে তাকে টিকিট ছাড়াই ট্রেনে তুলে দেন। তিনিও আত্মগোপন করেছিলেন।”
স্ট্যাটাসে আরও উল্লেখ করা হয়, বিস্ময়কর হলেও বেনাপোল কাস্টম হাউস কর্মকর্তাদের তৎপরতায় এ অঞ্চলে প্রথম ‘করোনাভাইরাস রোগী দেশে ঢোকার আগেই ধরা পড়ে।’
ওই দিন দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে কাস্টমস কমিশনার দুঃখ প্রকাশ করে ফের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, “চিকিৎসকের পরীক্ষায় তাকে ‘করোনাভাইরাস’মুক্ত বলা হয়েছে। আমরা নিজেদের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি। ভারতীয় রেল গার্ড মেনিফেস্ট দিতে গিয়ে বেনাপোল কাস্টম টিমের রাজস্ব কর্মকর্তাকে (আরও) বলেন, ‘ট্রেনে ৬৫ জন যাত্রী, একজন অনুপস্থিত ও একজন করোনা রোগী আছে’! তাৎক্ষণিক চেকপোস্টের ডা. আজিমউদ্দিন আসেন এবং তার পাসপোর্ট দেখে তাকে সম্ভাব্য রোগী হিসেবে আলাদা করেন। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করেন।”
‘গার্ডের বক্তব্য, ডাক্তারের করোনা সন্দেহযুক্ত যাত্রী খুঁজে পাওয়া ও যাত্রীর ভাবভঙ্গি থেকে তাকে আমাদের টিম সন্দেহবশত করোনা রোগী বলেছে। এ বিষয়ে কোনো সংশয় তৈরি হলে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত!’
করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানো প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘সবাই সতর্ক থাকুন, সচেতন থাকুন, নিরাপদে থাকুন। আমরা সচেতনতার জন্য পোস্ট দেই। সংশয়ের জন্য নয়। দয়া করে কেউ আতঙ্ক ছড়াবেন না। কাস্টম চেকপোস্টে সচেতনতার জন্য আমরা গত ২৯ জানুয়ারি করোনা সচেতনতা সেমিনার করি। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের প্রদর্শিত নির্দেশনালোকে কাস্টম টিম দায়িত্বের অংশ হিসেবে রোগী আলাদা করে স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে হস্তান্তর করেন।’
এ প্রসঙ্গে বেনাপোল রেলস্টেশন মাস্টার সাইদুজ্জামান বলেন, “স্টেশনে এ ধরনের এক রোগীর ব্যাপারে কাস্টম কর্তৃপক্ষ ‘করোনাভাইরাস’ আক্রান্ত রোগী বলে সন্দেহ করেছিল। পরে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এটা একটি নিছক গুজব।”
প্রসঙ্গত, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এর উৎপত্তিস্থল হুবাই প্রদেশে আরও ১০৮ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে চীনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২১১২ জনে। বিশ্বব্যাপী এ সংখ্যা অন্তত ২১২০ জন। চীনের বাইরে অন্তত আটজন মারা গেছেন। এর মধ্যে হংকং ও ইরানে দুজন করে এবং তাইওয়ান, জাপান, ফ্রান্স ও ফিলিপাইনে একজন করে মারা গেছেন।
হুবেই স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) জানায়, বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনা প্রদেশের রাজধানী উহানে, যেখানে ডিসেম্বরে ভাইরাসটি প্রথম প্রকাশ পায়। বুধবার নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন আরও ৩৪৯ জন। তবে এটি তার আগের দিনের চেয়ে ১৬৯৩ জন কম।
হুবেইয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৩১ জনে। সারাবিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ২৬২ জনে। এর মধ্যে বেশির ভাগই চীনের।
এমএআর/জেআইএম