জয়পুরহাটের প্রতিনিধিত্ব করেছেন সাংবাদিক সুজন হাজারী
জীবন সংসারে ঘর সাজানোর এক সুনিপুণ কারিগর ছিলেন জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার প্রবীণ সাংবাদিক সুজন হাজারী। যার নিপুণ ক্ষুরধার লেখনিতে হাজার হাজার একর জমির সেচ-সুবিধায় চাষীর ভাগ্য ফিরেছে। পানির জলাবদ্ধতা দূর হয়েছে। নির্মিত হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, ব্রিজ-কালভার্ট ও স্লুইস গেটের সংস্কার হয়েছে।
পিছিয়ে পড়া ও সুবিধা বঞ্চিত জাতিগোষ্ঠীদের ন্যায্য অধিকারের দাবি নিয়ে প্রবীণ সাংবাদিক সুজন হাজারীর সংবাদের একটি স্লোগান ‘আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার চাই’ যা আন্তর্জাতিক দাবিতে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন : নওগাঁর সাংবাদিকদের গর্ব শেখ আনোয়ার হোসেন
সাংবাদিক সুজন হাজারী ইন্টারমিডিয়েট পড়া অবস্থায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত মাওলানা ভাষানী কর্তৃক সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক প্রাচ্যবার্তা’ দিয়ে তার ক্ষুরধার লেখনির সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। তার সাংবাদিকতা দিগন্তের উন্মেষকালীন তিনি ঢাকার প্রথিতযশা সম্পাদক মতিয়র রহমান মল্লিকের সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক একতা, দৈনিক আজকের কাগজ ও দৈনিক ভোরের কাগজে সাংবাদিকতা করেন।
আরও পড়ুন : চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাংবাদিকদের গুরু তালেবুন নবী
একই সম্পাদক মতিয়র রহমানের বিগহাউস প্রিন্টিং মিডিয়া, দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। সম্পাদক প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত হতে বিশিষ্ট লেখক মোস্তফা কামালকে তার বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রথম আলোয় কাজ করার পর কোনো এক কষ্টে সেই পত্রিকা ছেড়ে দেন। এরপর একই সালে ‘দৈনিক মানব কণ্ঠ’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ পত্রিকায় কাজ করেছেন তিনি। এখন রয়েছেন ‘সাপ্তাহিক একতা’ পত্রিকায়।
আরও পড়ুন : হাতে কলমে অনেককে সাংবাদিকতা শিখিয়েছেন বগুড়ার বেচান
সাংবাদিক সুজন হাজারী তার সাংবাদিক জীবনের স্মৃতিচারণে জানান, তিনি ১৯৯৭ সালের দিকে পাঁচচিবিতে পামডো এনজিও আয়োজিত আদিবাসীদের এক সমাবেশ ও সেমিনারে বিশেষ অতিথি হয়েছিলেন। প্রথান অতিথি ছিলেন তৎকালীণ জেলা প্রশাসক আবু নাসির। সেই সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি সুবিধাবঞ্চিত, পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী আদিবাসীদের অন্যান্য ন্যায়সঙ্গত দাবির সঙ্গে তাদের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি তোলেন।
আরও পড়ুন : সিরাজগঞ্জের সাংবাদিকদের আদর্শ রফিকুল আলম খান
পাঁচবিবি থেকে তোলা এ দাবি পরে তা আদিবাসীদের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের দাবিতে পরিণত হয়েছে। তার লেখায় জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে ভাষা আন্দোলনের শহীদ মিনার ও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এ কলম সৈনিকের কলম জোয়ালের লেখায় পাঁচবিবির ধরঞ্জী ইউপির দোঘরা স্লুইস গেটের সংস্কার হয়। এতে করে এলাকার কয়েক হাজার কৃষক জলাবদ্ধতামুক্ত সেচ সুবিধায় তাদের ভাগ্য ফেরায়। পাঁচবিবির গোদাইপুর গ্রামের সারা বছরের জলাবদ্ধতা দূর হয়। সেখানে নির্মিত হয় ব্রিজ-কালভার্ট। প্রতিষ্ঠিত হয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কুসুম্বা ইউপিতে একটি খালে ব্রিজ নির্মিত হয়।
আরও পড়ুন : পাবনায় সাংবাদিকতার ডায়েরি মোসতাফা সতেজ
প্রবীণ সাংবাদিক সুজন হাজারী প্রভাবশালীদের প্রভাবকে তোয়াক্কা না করে হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার না করার সংবাদ করলে প্রভাবশালী আসামি গ্রেফতার হয়। সংবাদের জন্য রাজনৈতিক দলের হামলার শিকার হন। প্রকাশ্যে মাইকযোগে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। চোরাকারবারীর বিরুদ্ধে সংবাদ হলে তাকে চোরাকারবারী দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়। চোরাকারবারীরা তাকে লাঞ্ছিত করে তার ক্যামেরা ভাঙচুর করে।
আরও পড়ুন : রংপুর অঞ্চলের সাংবাদিক তৈরির কারিগর বাটুল
সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চার রাগরাগীনিতেও ছিল তার দখল। সাহিত্য অঙ্গনে তার লেখা কবিতা, গল্প, ছড়া প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাকে পুরস্কৃত করেছে। তার লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ রয়েছে। এসব গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিভিন্ন নামিদামি পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন বইয়ে ছাপা হয়েছে। তার লেখা কবিতার ৩টি বই ‘কৃষ্ণপক্ষে সংক্রান্তি’, ‘ভালবেসে রাজা হব’, ‘জন্মদাহ’, সর্বমহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
আরও পড়ুন : গাইবান্ধায় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার উদাহরণ আবু জাফর সাবু
এ বিদগ্ধ লেখক, কবি, সাংবাদিক সুজন হাজারীর লেখা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন সম্পাদিত ‘ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস’ বইটিতে সংকলিত হয়েছে। সাংবাদিক সুজন হাজারী ঢাকার বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ও জয়পুরহাট প্রেসক্লাবের সদস্য।
আরও পড়ুন : শুধু সাংবাদিকতা করতেই সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন পঞ্চগড়ের শহীদ
সামরিক শাসন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তার লেখা একটি কবিতা যা তার কবিতার বই ‘জন্মদাহ’ এর মহাকাব্য কবিতাটি বহুল আলোচিত হয়। কবিতাটির একটি পংক্তি ‘কার্ফুমাখা রাত দীর্ঘতম হলে, ধূসরতায় মেলে যায় দ্রুততম রেলগাড়ী’ এতসব সাহিত্য সম্ভারের দরুণ তিনি বার বার পুরস্কৃত হয়েছেন।
আরও পড়ুন : ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিকদের মশাল আব্দুল লতিফ
ছড়ার জন্য ঢাকার ‘পাপস সাহিত্যগোষ্ঠী’, গল্পের জন্য গাইবান্ধার নীলমণি সাহিত্য সংসদ এবং গল্প ছড়া ও কবিতার জন্য রংপুর অভিযাত্রী সাহিত্যগোষ্ঠী ৪ বছরে ৪ বার তাকে পুরস্কৃত করেন। সাংবাদিকতার জন্য জয়পুরহাটে নাগরিক সংবর্ধনা পান। সাহিত্যের জন্য দিনাজপুর জেলার স্বামী বিবেবকানন্দ পরিষদ থেকে সম্মাননা ও সংবর্ধনাও পেয়েছেন। বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের দেশব্যাপী সাহিত্য প্রতিযোগিতায় তিনি পর পর ২ বার পুরস্কৃত হন।
আরও পড়ুন : কুড়িগ্রামের সাংবাদিকদের আদর্শ শাহাবুদ্দিন স্যার
ছাত্র জীবন থেকেই তিনি খেটে খাওয়া মেহেনতী মানুষের কথা ভাবতেন। এ তাড়নায় তাকে আদর্শ ভিত্তিক দল ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করে। এ কারণেই ছাত্র জীবনে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন ও মিছিল সমাবেশে অংশ নেন।
আরও পড়ুন : কালীগঞ্জের উন্নয়নে অনেক অবদান সাংবাদিক আলিমের
প্রতিভাধর এ সাংবাদিক ১৯৫৩ সালের ১৪ মে ভারতের এনায়েতপুর জেলার হিলি থানাধীন উজাল গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম আমীর উদ্দিন মন্ডল ছিলেন অবিভক্ত ভারতের একই দিনাজপুর জেলার প্রতাপশালী জমিদার প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার, ব্রজরাখাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ মজুমদার, বিশাল জমিদারি নায়েক। যতদিন জমিদারি ছিল ততদিনই তিনি নায়েকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের চেঁচড়া গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। এখান থেকে অবিভক্ত ভারতসহ তৎকালীণ বাংলাদেশে অবস্থিত জমিদারগণের বিশাল জমিদারি দেখাশুনা করতেন। চেঁচড়া গ্রামে আজও তাদের বাড়ি রয়েছে।
আরও পড়ুন : মফস্বল সাংবাদিকদের গর্ব নীলফামারীর তাহমিন হক ববি
সাংবাদিক সুজন হাজারী পাঁচবিবি শহরের দানেজপুরে বর্তমানে বসবাস করে আসছেন। তিনি শিশুকালে পাঁচবিবি রামভদ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে হিলি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭২ সালে জয়পুরহাট সরকারি ডিগ্রি কলেজ থেকে ১ম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৭৫ সালের সেশনে পাঁচবিবি মহিপুর সরকারি কলেজের ২৫/৩০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে একমাত্র তিনিই বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
প্রতিভাবান সাংবাদিক সুজন হাজারী ১৯৭৭ সালে জনতা ব্যাংকে চাকরি জীবন শুরু করেন এবং ২০১১ সালে পাঁচবিবি শাখা জনতা ব্যাংকে সহকারী নির্বাহী অফিসার পদে চাকরিরত অবস্থায় অবসরে যান।
কৃতি সাংবাদিক সুজন হাজারী দাম্পত্য জীবনেও ছিলেন সফল পুরুষ। সাংবাদিক সুজন হাজারী ১৯৯২ সালের পাঁচবিবির সম্ভ্রান্ত পরিবারের নাসরিন আক্তার শিল্পীকে বিয়ে করেন। তার শ্বশুর মকবুল সরকার চাকরি জীবনে ছিলেন জয়পুরহাট চিনিকলের ভাণ্ডার রক্ষক। পাঁচবিবি পৌরসভা ও উপজেলার উন্নয়নে তার স্ত্রী শিল্পীর রয়েছে অনন্য অবদান। শিল্পী দুই দুই বার পৌর কাউন্সিলর ও একবার পাঁচবিবি উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
দাম্পত্য জীবনে সাংবাদিক সুজন হাজারী ৩ ছেলের সন্তানের পিতা। সন্তানদের মধ্যে তার ২ ছেলে যমজ। বড় ছেলে সুবর্ণ সম্ভার জাপানের দি-এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করছে। ইতোমধ্যেই অনার্স শেষ করেছে। যমজ ২ ছেলে সুদীপ্ত সম্ভার ও সুহৃদ সম্ভার বগুড়া ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে।
সুজন হাজারীর সহধর্মিণী নাসরিন আক্তার শিল্পী জাগো নিউজকে বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ করায় পারিবারিকভাবে আমাদের অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। সংবাদের কারণে অনেক সময় অনেক রাতে বাড়ি ফিরলে দুশ্চিন্তায় পড়তে হতো, তবুও স্বাধীনভাবে সংবাদ লিখতে কখনও বাধা দেইনি। এক সময় ঝুঁকিপূর্ণ সংবাদগুলো বাদ দিতে বলেছি, কখনও কখনও সাংবাদিকতা ছেড়ে দিতে বলেছি, তবুও সে থেমে থাকেনি।
সুজন হাজারীর ছেলে সুদীপ্ত সম্ভার জানান, সত্য অন্বষণে আমার বাবাকে কখনও পিছু হটতে দেখেনি, এতে করে অনেক হুমকি-ধামকির শিকার হতে হয়েছে।
পাঁচবিবি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মো. জহুরুল ইসলাম সরকার বলেন, বস্তনিষ্ট সংবাদ লেখা, সমাজের অবহেলিত ও নিপীরিত মানুষের কথা, সমাজের নানা সমস্যা, উন্নয়নের কথা ও সত্যকে তুলে ধরতে কখনও তাকে পিছপা হতে দেখিনি।
জয়পুরহাটের সাংবাদিক খ.ম আব্দুর রহমান রনি জানান, সাংবাদিকতা করাকালে যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন এবং সততার সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি।
রাশেদুজ্জামান/এমএএস/এমএস