প্রবাসীর খপ্পরে সর্বস্বান্ত নওগাঁর ১০ যুবক

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি নওগাঁ
প্রকাশিত: ০৫:১১ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯
সবুজের খপ্পরে পড়ে এখন সৌদির কারাগারে জুয়েল রানা

নওগাঁ সদর উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের চককালিদাস গ্রামের ১০ যুবক ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে জমিজমা বিক্রি ও ঋণ করে পাড়ি জমিয়েছিলেন সৌদিতে। কিন্তু একই গ্রামের প্রবাসী সবুজ সরদারের (৩০) খপ্পরে পড়ে সেখানে আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

ভুক্তভোগীদের পরিবারের অভিযোগ, স্বজনদের আকামা করে দেয়ার নামে সবুজের বাবা কোমর উদ্দিন (৬৫) ও মা রোকেয়া বিবিকে (৪৫) টাকা দিয়েছেন তারা। কিন্তু সবুজ আকামা না করে উল্টো পাসপোর্ট কেড়ে নিয়েছেন। তার বাবা-মা টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করছেন। বিষয়টি নিয়ে নওগাঁ সদর থানায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দেয়া হয়েছে। সমঝোতার জন্য সবুজের পরিবারের পক্ষ থেকে সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আড়াই লাখ টাকা দেয়ার দাবি করা হলেও তিনি অস্বীকার করছেন।

স্থানীয়রা জানান, একসময় সবুজের পরিবার অন্যের বাড়িতে কামলা দিত। একযুগ আগে স্ত্রী-পরিবার রেখে সৌদি পাড়ি জমান সবুজ। সেখানে বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করতেন। একসময় নিজেই ‘আল-আহাদ আল-আরাবিয়া’ নামে শ্রমিক সরবরাহের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং সৌদিতে নির্মাণকাজের জন্য শ্রমিক পাঠাতে শুরু করেন। কয়েক বছর ধরে গ্রামের যুবকদের তার প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে কাজের সুযোগ করে দেয়ার প্রলোভন দেন। এলাকার যুবকরা ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে কেউ জমি বিক্রি করে, কেউ ঋণ করে সৌদি পাড়ি জমান। তারা সবুজের অধীনে কাজ করলেও ঠিকমতো বেতন দেয়া হতো না। আকামা করে দেয়ার নামে সবুজ টাকা চাইলে তারা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর স্বজনরা সবুজের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আকামার টাকা তার বাবা-মার কাছে দিতে বলে। সে কথা মতো তারা সবুজের বাবা-মাকে টাকা দেন। এরপর সবুজ আকামা না করে দিয়ে টালবাহানা করতে থাকে। এমনকি এসব যুবকের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে তার প্রতিষ্ঠান থেকে তাড়িয়ে দেয়। এভাবে সবুজের পরিবার আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। ফসলি জমি কিনেছেন ৬-৭ বিঘা। গ্রামে ৫-৬ কাঠা ভিটা জমি কিনে সেখানে ফ্লাট বাড়ি করেছে। ভুক্তভোগীর স্বজনরা টাকা চাইতে গেলে সবুজ তার এক সরকারি কর্মকর্তার আত্মীয়র মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখায়।

Naogaon-3.jpg

সবুজের ভিজিটিং কার্ড

ভুক্তভোগী সিরাজুল ইসলাম জানান, তার ছেলে রুবেল হোসেন দুই বছর আগে সাড়ে ৬ লাখ টাকা দিয়ে সৌদিতে যায়। সেখানে একটি কোম্পানিতে ৬ মাস কাজ করে। এরপর সুবজের শ্রমিক সরবরাহের কোম্পানিতে কাজ শুরু করে। ছেলের আকামা করে দেবে বলে সবুজ তার বাবা-মায়ের কাছে ৩ লাখ টাকা দিতে বলে। সেই কথা মতো ১ বছর আগে তাদের বাড়িতে গিয়ে টাকা দেয়া হয়। এরপর থেকেই সবুজ টালবাহানা শুরু করে। ছেলের আকামা করে দেয়নি। তার কোম্পানিতে যে চার মাস কাজ করেছিল তার বেতনও দেয়নি।

তিনি বলেন, ছেলের আকামা করে না দেয়ায় তিন মাস আগে সবুজের বাবা-মায়ের কাছে টাকা চাইতে গেলে উল্টো তারা থানায় চাঁদাবাজীর অভিযোগ দেয়। একদিন পুলিশ বাড়িতে এসে হুমকি ধামকি দেয়। পরে আমিও থানায় অভিযোগ করি। বিষয়টি খুলে বলা হলে দুই পক্ষকে থানায় ডেকে পাঠায় পুলিশ। বৈঠকে তারা ৩ লাখ টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে এবং ১০/১১/১৯ তারিখে আড়াই লাখ টাকা দেয়ার শর্তে আপসনামা হয়। কিন্তু সেই টাকা আজও হাতে পাইনি। শুনেছি টাকা পুলিশের (এসআই মামুন স্যার) কাছে আছে। তিনি টাকা না দেয়ার জন্য টালবাহানা করছেন।

একই গ্রামের রাশিদুল বলেন, তার ভগ্নিপতি জুয়েল রানা এক বছর আগে জমানো টাকা, জমি বন্ধক ও ঋণ করে সৌদিতে গেছেন। এরপর সবুজের কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। তার কোম্পানিতে ৮ মাস কাজ করলেও ২ মাসের বেতন দেয়। আকামা করে দেবে এজন্য সবুজের বাবা-মায়ের কাছে ৩ লাখ টাকা দিতে বলেন ভগ্নিপতি। সে মোতাবেক তার বাবা-মায়ের কাছে ৩ লাখ টাকাও দেয়া হয়। কিন্তু সবুজ ভুয়া আকামা করে দেয়। একদিন ভগ্নিপতি কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার পথে পুলিশ তাকে আটক করে। সেদিনই শুধু কথা হয়। গত চারমাস থেকে জেলে আছেন।

একই গ্রামের প্রবাসী সাইদুলের স্ত্রী রুমা, আয়নালের বাবা লতিফ, জিয়াউর রহমানের ভাই লুৎফর রহমানসহ আরও কয়েকজন অভিযোগ করেন, তাদের স্বজনরা সবুজের মাধ্যমে সৌদিতে যায় এবং তার কোম্পানিতে কাজ শুরু করে। কিন্তু কাজ করলেও বেতন দেয়নি। এরপর আকামা করে দেয়ার নামে তার বাবা-মায়ের কাছে টাকা দেয়া হয়। কিন্তু তারা এখন টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করছেন। এছাড়া সৌদিতে যারা আছেন তাদের কাছ থেকে পাসপোর্টও কেড়ে নিয়েছেন সবুজ। এমনকি কয়েক দিন খেতেও দেয়নি। এখন তারা সৌদিতে গোপনে অবস্থান করছেন। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তারা।

Naogaon-3.jpg

চককালিদাস গ্রামে সবুজের বাড়ি

সবুজের মা রোকেয়া বেগম বলেন, আমার ছেলে (সবুজ) ১৩ বছর ধরে সৌদিতে থাকে। সেখানে রঙয়ের কাজ করে। কোনো শ্রমিক সরবরাহ করে না। আর আমার কাছে কেউ টাকা দেয়নি, সব অভিযোগ মিথ্যা। তবে এসব বিষয় মামুন স্যার (এসআই আব্দুল্লাহ আল মামুন) জানেন। জমিজমা কেনা ও ঘরবাড়ি তৈরিতে এনজিও থেকে অনেক টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে।

সবুজের মামা আবুল কালাম বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমঝোতার আড়াই লাখ টাকা এসআই মামুনকে দেয়া হয়েছে। থানায় বৈঠক হয় এবং থানাতেই টাকা দেয়া হয়েছে। এখন বাদীরা টাকা পেল কি না তা আমার দেখার বিষয় না।

এ বিষয়ে নওগাঁ সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, কোনো সমস্যা যেন না হয় এজন্য সবুজের পরিবার ও সিরাজুল ইসলামকে থানায় ডেকে সমঝোতার বিষয়ে উপস্থিতি তিনজন করে ছয়জনের সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়া হয়। টাকা লেনদেনের বিষয়ে কোনো স্বাক্ষর নেয়া হয়নি, কেউ আমাকে টাকা দেয়নি। তবে এলাকাবাসী তাদের (সবুজের বাবা-মা) টাকা দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের উভয়ের মধ্যে টাকা লেনদেন হয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো কাগজপত্র কেউ দেখাতে পারেনি। তবে টাকা না দিলে কেউ কাউকে চাপ দিতে পারে না।

নওগাঁ সদর থানার তদন্ত কর্মকর্তা ফয়সাল বিন আহসান বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করা হয়। তাদের মধ্যে মৌখিকভাবে লেনদেন হয়েছে, প্রমাণ স্বরূপ কোনো কাগজপত্র নেই। বস্তুনিষ্ট কোনো সাক্ষ্য প্রমাণও পাওয়া যায়নি। এছাড়া যার বিরুদ্ধে অভিযোগ (সবুজ সরদার) সেও দেশের বাইরে।

আব্বাস আলী/এমএমজেড/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।