লাউয়াছড়ায় শতবর্ষীসহ অর্ধশতাধিক গাছ কাটার আয়োজন

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি মৌলভীবাজার
প্রকাশিত: ১০:০৩ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

খাবারের অভাবে বন্যপ্রাণীরা যখন প্রায়ই ছুটে আসছে লোকালয়ে, তখন তাদের জন্য ফলের নতুন গাছ না লাগিয়ে উল্টো ৫০ থেকে ১০০ বছরের গাছের সঙ্গে আমলকি, জারুল, বহেরা, ডুমুরসহ অর্ধশতাধিক ফলের গাছ কাটার আয়োজন করা হয়েছে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের চাউতলী বিটে। স্থানীয় বন বিভাগ এ কাজ করেছে। ফলে সেখানে থাকা উল্লুক, চশমাপড়া হনুমানসহ বিরল প্রজাতির ও পৃথিবীজুড়ে মহাবিপন্ন প্রাণীদের খাদ্য ও বাসস্থান আরও হুমকিতে পড়েছে।

জানা যায়, লাউয়াছড়ার পার্শ্ববর্তী বিট চাউতলীর আয়তন ৩২ হেক্টর। ১০ বছর আগে এর ১০ ভাগ জমিতে সামাজিক বনায়ন করে বন বিভাগ। লাগানো হয় আকাশমণি ও বেলজিয়াম গাছ। এখন সময় হয়েছে সেই গাছ কেটে উপকারভোগীদের টাকা ফিরিয়ে দেয়ার। সে জন্য ১০ বছর আগে লাগানো সামাজিক বনায়নের গাছ কাটার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সামাজিক বনায়নের গাছের পাশাপাশি বনের দুর্লভ এবং বন্যপ্রাণীদের খাবারের প্রয়োজনীয় গাছও কাটার জন্য বাছাই করেছে মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। যদিও এসব গাছ ৫০ থেকে একশ বছর আগের।ও এগুলো বনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বন্যপ্রাণীরা গাছগুলো থেকে খাবার সংগ্রহ করে।

চাউতলি বিট ঘুরে দেখা যায়, সেখানে ফলের গাছসহ বিভিন্ন বিরল প্রজাতির গাছ কাটার জন্য বিশেষ চিহ্ন (লাল নম্বরযুক্ত) দিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বহেরা, ডুমুর, হরিতকি, আমলকি, জারুল, রিঠা, ডেউয়া, লটকন, কাঠ বাদাম, লুকলুকি, বন উরি, কাউফল, কাটা জামসহ অর্ধশতাধিক ফল গাছ। এসব অনেক গাছেরই বয়স ৫০ থেকে ১০০ বছর। যার ফল খেয়ে বেঁচে আছে বন্যপ্রাণীরা।

এছাড়াও কাটার জন্য বাচাই করা হয়েছে অতি মূল্যবান ধূপ, শতবর্ষী চাপালিক এবং সাতটি বড় বড় লোহা কাঠের গাছ। এসব গাছ অতি মূলব্যান হওয়ায় কাটা হবে বলে অভিযোগ রয়েছে।

উল্লুক, চশমাপরা হনুমানসহ যে সব প্রাণী ফুলফল খেয়ে বেঁচে থাকে তাদের খাবারের গাছ এমনিতেই কমে গেছে লাউয়াছড়ায়। ফলে প্রায়ই লোকালয়ে ছুটে আসছে বন্যপ্রাণীরা। তার ওপর এভাবে গাছ কাটা হলে বন্যপ্রাণীর খাবারের অভাব আরও তীব্র হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কেন এসব গাছ কাটার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে প্রকৃতি ও সংরক্ষণ বিভাগের শ্রীমঙ্গল রেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন জাগো নিউজকে জানান, ১০ বছরের রোটেশনে এখন গাছের আবর্তন কাল। তাই গাছ কেটে উপকারভোগীদের টাকা দেয়া হবে। উপকারভোগীরা এতোদিন বাগান রক্ষা করেছে তাদেরকে এখন পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে। তবে, এ কর্মকর্তা জানান, ১০ বছর আগে যখন সামাজিক বনায়ন করার আগে থেকেই সেখানে অনেক গাছ ছিল।

mou1

তাহলে ১০ বছর আগের সামাজিক বনায়নের গাছের সঙ্গে কেন আগের গাছও কাটা হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, বনের উপকারভোগীরা চায় এসব গাছও কাটতে। তবে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নেবেন।

এদিকে লাউয়াছড়ার মত সংরক্ষিত একটি বনে ৫০ থেকে একশ বছরের গাছ কাটার পরিকল্পনাকে অপরাধ বলে মন্তব্য করছেন পরিবেশবাদীরা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ১০ বছর আগে সামাজিক বনায়নের সময় ঠিক মতো টাকা খরচ করেননি তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এখন উপকার ভোগীদের বনায়নের টাকা ফেরত দেয়ার সময় এসেছে। তাই তাদের গাছের সঙ্গে বনের পুরানো গাছও কাটার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে ঝুঁকির মুখে পড়তে চলেছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মূল্যবান প্রাণীজগৎ। সেই সঙ্গে চলছে লাখ লাখ টাকার বনজসম্পদ লুটপাটের পাঁয়তারা।

বন্যপ্রাণী গবেষকরা জানান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান জীববৈচিত্র্যপূর্ণ সংরক্ষিত বন। এখানে উল্লুক, চশমাপরা হনুমান, লজ্জাবতী বানর, উড়ন্ত কাঠবিড়ালিসহ পৃথিবীজুড়ে মহাবিপন্ন নানা প্রাণী রয়েছে। এসব প্রাণী খাদ্যের জন্য সম্পূর্ণ ফল গাছের ওপর নির্ভরশীল। তাই ফল গাছ কেটে ফেললে হুমকিতে পড়বে তাদের অস্তিত্ব।

তারা জানান, এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনার ফল গাছের সংখ্যা কমেছে লাউয়াছড়ায়। ফলে প্রায়ই বন্যপ্রাণীরা সেখান থেকে বের হয়ে লোকালয়ে চলে আসে। এ কারণে এ বনে আরও বেশি করে ফলজ গাছ লাগানো দরকার।

এ বিষয়ে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (পরিবেশ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ) ড. বিশ্বাস করবী ফারহানা জাগো নিউজকে জানান, এসব গাছ কাটা হলে বন্যপ্রাণীরা খাবার এবং বাসস্থানের সংকটে পড়েবে। ছুটে যাবে অন্যত্র। ফলে কিছু প্রাণী মারাও যাওয়ারও আশঙ্কা আছে।

তিনি আরও জানান, ব্যক্তিগত লাভের জন্য এত পুরাতন গাছ কেটে নেয়ার ফলে হুমকিতে পড়বে
ন্যাচারাল ইকো সিস্টেম। তাই যে কোনোভাবেই হোক এসব গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। যে সব ফলের গাছ কাটার জন্য প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে তার সবই বন্যপ্রাণীদের খাবারের জন্য দরকারি। খাবারের অভাব থাকলে বন্যপ্রাণীরা বন থেকে বের হয়ে লোকালয়ে চলে আসতে পারে।

এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ) আবদুল ওয়াদুদ জানান, বিষয়টি জানার পর ফলের এবং পুরাতন গাছ কাটার বিষয়টি বাতিল করে দেয়া হয়েছে। এসব গাছ রক্ষা করা হবে। তবে, সামাজিক বনায়নের আওতায় লাগানো আকাশমণি ও বেলজিয়াম গাছগুলোকে কাটা হবে।

রিপন দে/এমএমজেড/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।