অভিযোগ দেয়ায় ১১ পরিবারকে গ্রামছাড়া করলেন যুবলীগ নেতা

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি শরীয়তপুর
প্রকাশিত: ০৫:৩৭ পিএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯
অভিযুক্ত যুবলীগ ও গ্রামছাড়া পরিবারগুলোর ঘরে তালা

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় এক যুবলীগ নেতার ভয়ে ১১টি পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছেন। একই সঙ্গে আরও ১৫টি পরিবার পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।

উপজেলার নশাসন ইউনিয়নের পাড়াগাঁও গ্রামে এমন ঘটনা ঘটেছে। যুবলীগ নেতার ভয়ে ১১টি পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পাশাপাশি আরও ১৫টি পরিবার পুরুষশূন্য হয়ে পড়ায় ছেলে-মেয়েদের লেখাপাড়া ব্যাহত হচ্ছে। এ ঘটনায় নিরাপত্তা চেয়ে শরীয়তপুর পুলিশ সুপারের (এসপি) কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।

অভিযুক্ত মাসুম ছৈয়াল একই গ্রামের মৃত ছিটু ছৈয়ালের ছেলে। তিনি নশাসন ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে নড়িয়া ও পালং মডেল থানায় মাদক, বিস্ফোরকসহ ১২টি মামলা রয়েছে।

গ্রামবাসী ও ভুক্তভোগী পরিবারগুলো জানায়, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে গ্রামের কয়েক ব্যক্তির ফসলি জমিতে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে নিজ বাড়িতে বালি উত্তোলন করছিলেন মাসুম ছৈয়াল। স্থানীয় প্রশাসনের নজরে এলে ড্রেজার মেশিনটি পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়।

ওই গ্রামের বাসিন্দা জলিল আকন প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়েছে এমন অপবাদ দিয়ে তাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে মাসুম ও তার বাহিনী। বর্তমানে জলিল আকন ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এ ঘটনায় জলিল আকনের ভাই এমদাদ আকন বাদী হয়ে মাসুমকে প্রধান আসামি করে ১০ জনের বিরুদ্ধে নড়িয়া থানায় মামলা করেন। মামলায় জামিনে বেরিয়ে এলাকায় তাণ্ডব শুরু করেন মাসুম। পাশাপাশি মামলা তুলে নিতে বাদীপক্ষের লোকজনের ওপর হামলা, বাড়িঘর লুটপাট ও মারধরসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেন তিনি।

স্থানীয় সূত্র জানায়, মাদক বিক্রি ও নানা ধরনের অপকর্মের জন্য বাহিনী গঠন করেছেন মাসুম ছৈয়াল। তার বাহিনীর নাম মাসুম বাহিনী। মাসুমের বিভিন্ন অপকর্মে কেউ বাধা দিলে কিংবা থানা পুলিশকে জানালে নেমে আসে নির্যাতন। মাসুমের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ এবং মামলা দেয়ায় তার বাহিনীর ভয়ে পাড়াগাঁও গ্রামের ধলু আকন, এনায়েত আকন, জলিল আকন, খলিল আকন, কাদির আকন, আনসার আকন, আলম আকন, আজিদ আকন, মাসুম আকন, ভুট্টু আকন ও নরুল হক আকন ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

একই সঙ্গে মাসুম বাহিনীর ভয়ে ওই গ্রামের আরও ১৫টি পরিবার পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। পরিবারগুলোর ছেলে-মেয়েদের লেখাপাড়া ব্যাহত হচ্ছে। এ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন এলাকাবাসী।

ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য ঝুমা আক্তারের ভাষ্য, আমি ডোমসার জগৎ চন্দ্র ইনস্টিটিউশন অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণিতে পড়ি। মাসুম ও তার বাহিনীর ভয়ে আমার বাবা ও ভাই বাড়িতে আসতে পারে না। আমি ভয়ে স্কুলে যেতে পারি না। আমার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার পথে।

ভুক্তভোগী ধলু আকন বলেন, মাসুম মাদক সেবন ও বিক্রি করেন। গ্রামে মাদক বিক্রি করা যাবে না প্রতিবাদ করলে আমাকে রাতে একা পেয়ে ৮-১০ জন মিলে কুপিয়ে জখম করে। আমি এখনো অসুস্থ। এ ঘটনায় মামলা করেছি। মামলা করার পর এখন বাড়িতে থাকতে পারি না। মাসুম বাহিনীর ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।

গ্রামবাসী জানায়, মাদক বিক্রিতে বাধা দেয়ায় এই গ্রামের লিটন হাওলাদার, জসিম দেওয়ান ও জলিল আকনকে কুপিয়েছে মাসুম ও তার বাহিনী। মাসুমের ভয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। একাধিক মামলার আসামি হলেও তাকে গ্রেফতার করছে না পুলিশ। আমরা তার বিচার চাই। তাকে আইনের আওতায় আনলে এই গ্রামের মানুষ শান্তি পাবে।

নশাসন ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সামসুদ্দিন সরদার বলেন, ড্রেজার ও মাদক সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মাসুম ও তার বাহিনীর ভয়ে পাড়াগাঁও গ্রামের অনেক পরিবার গ্রামছাড়া। এ বিষয়ে আমি আইন-শৃঙ্খলা মিটিং ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেছি। গ্রামছাড়া পরিবারগুলো যাতে বাড়ি ফিরতে পারে তার ব্যবস্থা করার জন্য পুলিশকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু ছয় মাস পার হলেও এখনো কোনো সমাধান হয়নি।

এ বিষয়ে নশাসন ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুম ছৈয়াল বলেন, আমরা গ্রাম্য রাজনীতি করি। আমাদের নেতা নশাসন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন তালুকদার। আর বিপক্ষ দলের নেতা নশাসন ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সামসুদ্দিন সরদার। তাদের সঙ্গে জমি সংক্রান্ত ও রাজনীতি নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে আমাদের। সামসুদ্দিন সরদাররা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। গ্রামছাড়া পরিবারগুলোর সদস্যরা বিভিন্ন মামলার আসামি। তাই পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পুরুষশূন্য পরিবারগুলোরও একই অবস্থা।

শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) আব্দুল মোমেন বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নড়িয়া থানা পুলিশের ওসিকে বলব। গ্রামছাড়া পরিবারগুলো যাতে ঘরে ফিরতে পারে সে ব্যবস্থা করবে পুলিশ।

জানতে চাইলে নড়িয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান বলেন, যেসব আসামি জামিনে আছে তাদের তো আমরা গ্রেফতার করতে পারি না। পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে মাসুমের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি। নির্দেশনা পেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মো. ছগির হোসেন/এএম/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।