ভোমরা বন্দর ছাড়ছেন ব্যবসায়ীরা
ভারত থেকে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি পণ্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফল। এছাড়াও অন্যান্য পণ্যও রয়েছে। আমদানি সহজ ও পরিবহন খরচ কম হওয়ায় ভোমরা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী ব্যবসায়ীরা। তবে নানা কারণে ব্যবসায়ীরা এখন ভোমরা বন্দর ছাড়ছেন। এতে কমছে আমদানি, সেই সঙ্গে কমছে রাজস্ব আদায়ও।
২০১৮-১৯ অর্থ বছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ফল আমদানি ৩০ শতাংশ কমেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় ভোমরা বন্দর ছাড়ছেন তারা।
ভোমরা স্থলবন্দরের রাজস্ব শাখার তথ্যে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বন্দর দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ফল আমদানি হয়েছে ৩২ হাজার ১৩৩ দশমিক ৪৩৪ টন। এর মধ্যে জুলাই মাসে ৩ হাজার ২৯৫ টন, আগস্টে ৮ হাজার ৩৯১, সেপ্টেম্বরে ১০ হাজার ৮৮২ ও অক্টোবরে ৯ হাজার ৫৬৫ দশমিক ৪৩৪ টন।
অন্যদিকে গত অর্থবছরে একই সময়ে এ বন্দর দিয়ে ফল আমদানি হয়েছিল ৪৫ হাজার ৭৯৩ টন। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১৩ হাজার ৬৫৯ দশমিক ৫৬৬ টন বেশি।
গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ফল আমদানিতে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১৫১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সেখানে চলতি অর্থবছরের গেল চার মাসে ফল আমদানিতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১০৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ফল আমদানি থেকে রাজস্ব আয় কমেছে ৪৪ কোটি টাকা।
ভোমরা স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ফারহাদ ইন্টারন্যাশনালের মালিক ওহিদুল ইসলাম জানান, আগে প্রতিদিন ৭০-৮০ টা করে ফলের ট্রাক বাংলাদেশে আসতো। কিন্তু বর্তমানে আসছে ২০-২২টি। প্রতি ট্রাক আনার ফলে (ডালিম) এক কেজিতে সরকারকে রাজস্ব দিতে হয় ৪৭ টাকা। ভারতীয় ট্রাকে ২১-২২ টন আনার ফল (ডালিম) আসে। সে হিসেবে ট্রাক প্রতি সরকার রাজস্ব পায় ১০-১১ লাখ টাকা। কমলা ফল প্রতি কেজি আমদানিতে রাজস্ব দিতে হয় ২৯ টাকা। প্রতি টনে সরকার রাজস্ব পায় ২৯ হাজার টাকা। সে হিসেবে প্রতি ট্রাকে সরকার রাজস্ব পায় ৬-৭ লাখ টাকা। সাদা আঙ্গুরে প্রতি কেজিতে ৪৮ টাকা আর কালো আঙ্গুরে ৫১ টাকা রাজস্ব দিতে হয়। সে হিসেবে টন প্রতি ৪৮ হাজার ও ৫১ হাজার টাকা রাজস্ব পায় সরকার। সাদা আঙ্গুরে প্রতি ট্রাকে ১১-১২ লাখ ও কালো আঙ্গুরে ১২-১৩ লাখ টাকা রাজস্ব পায় সরকার।
তিনি আরও জানান, দেশের স্থলবন্দরগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে সব থেকে দূরত্ব কমের বন্দর হচ্ছে ভোমরা। এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে মালামাল আনতে পরিবহন খরচ কম হয়। যার কারণে ব্যবসায়ীরা ভোমরা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী বেশি। বর্তমানে ফলের মৌসুম চলছে। তবে ফলের ট্রাক আগের মত আসছে না। ব্যবসায়ীরা অন্য বন্দর ব্যবহার করে মালামাল আমদানি করছেন।
ব্যবসায়ীরা ভোমরা বন্দর ছেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ী ওহিদুল ইসলাম বলেন, ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয় তার বেশির ভাগ রাজস্ব আসে কাঁচামাল থেকে। যা পচনশীল দ্রব্য। সরকারকে এত পরিমাণ রাজস্ব দিয়ে ভারত থেকে ভোমরা বন্দরে কাঁচামাল নিয়ে আসার পর বন্দর কর্তৃপক্ষ সেগুলোকে খালাস করতে গড়িমসি করে। খালাস করতে দেরি হওয়ায় কাঁচামালগুলো ট্রাকে পচতে শুরু করে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসায়ীরা। টাকা দিয়ে মাল এনে কোনো ব্যবসায়ী মাল পচিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চাইবে না। এছাড়াও কাস্টমস সুপার বিকাশ চন্দ্র দেবনাথ তিনি ব্যক্তি বিশেষের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আমদানিতে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেন। এ কারণেও ব্যবসায়ীরা ভোমরা বন্দর ছাড়ছেন।
বন্দরের ব্যবসায়ী মেসার্স রুমা ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. তরিকুল ইসলাম জানান, কাস্টমস সুপার বিকাশ চন্দ দেবনাথ বন্দরে নিজস্ব কিছু লোকজন পালন করেন। শুকনা ঝালের প্রতি ট্রাকে তিনি ৯ হাজার টাকা ঘুষ আদায় করেন কোনো কারণ ছাড়াই। ঘুষের এ টাকা না দিলে গাড়ি দেশে প্রবেশ করতে পারে না। এসব টাকা তিনি তার পোষ্যদের মাধ্যমে উত্তোলন করেন। এতেও ক্ষিপ্ত ব্যবসায়ীরা। এছাড়া ফলের ব্যবসায়ীরা যেখানে শতভাগ রাজস্ব দিয়ে মালমাল আমদানি করছে সেখানে অন্য ব্যবসায়ীরা এক মাল এনে অন্য কম দামের মালের ট্রাক্স দিচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা ভোমরা বন্দর থেকে মুখ ফিরেয়ে এখন বেনাপোল বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি করছে।
ভোমরা স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম জানান, অন্যান্য বন্দরে ফল আমদানিতে ব্যবসায়ীরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পায় ভোমরা বন্দরে তার কিছুই পায় না। অন্য স্থলবন্দরে প্রতি ট্রাক আনার (ডালিম) ফল আমদানি করলে কর্টুন বা বাক্সের মূল ওজন বাদ দিয়ে দেড় টন পর্যন্ত ওজনের বিপরীতে শুল্ক ছাড় দেয়া হয়। আপেল ও কমলা আমদানিতেও সমপরিমাণ ছাড় সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু ভোমরা বন্দরে কোনো ছাড় দেয়া হয় না। এতে আমদানি খরচ বেশি পড়ে ব্যবসায়ীদের। এ কারণেও ফল আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা ভোমরা বন্দর ত্যাগ করছেন।
তবে ভোমরা স্থলবন্দরের কাস্টমস সুপার বিকাশ চন্দ্র দেবনাথ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি কোনো অনৈতিক সুবিধা নেই না। এছাড়া ব্যবসায়ীদেরও কোনো হয়রানি করা হয় না। ব্যববাসীরা অভিযোগ দিলে আমি কি করবো। কোনো ব্যবসায়ী ভোমরা বন্দর ছেড়ে অন্য বন্দরে গেলে এখানে আমাদের কিছু করার থাকে না।
তিনি বলেন, পণ্য চাহিদার ওপর আমদানি কমবেশি হয়। ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ এলসি করবেন, তার বিপরীতে পণ্য আমদানি হয়। সম্প্রতি ফল আমদানি কিছুটা কমেছে। আগামীতে বাড়তেও পারে। সেই সঙ্গে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।
আকরামুল ইসলাম/আরএআর/পিআর