‘মনে হয়েছিল যেন শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটছে’
‘রাত তখন আনুমানিক পৌনে তিনটা। যাত্রীদের অনেকেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ বিকট শব্দে সবার ঘুম ভেঙে যায়। মনে হয়েছিল যেন শক্তিশালী কোনো বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছে। মুহূর্তেই পুরো ট্রেন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ভেতর থেকে বের হওয়ার রাস্তাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ সময় চোখের সামনে অনেককে মারা যেতে দেখি। এরপর স্থানীয়রা আমাকে উদ্ধার করে কসবা উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলেও জখম গুরুতর হওয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।’
মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজলার মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে ভোর রাত পৌনে ৩টার দিকে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আন্তনগর তূর্ণা নিশীথা ও সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী আন্তনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষে আহত যাত্রী সিএনজি চালক কাউছার (২৮) তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই বর্ণনা করেন।
কাউছার হবিগঞ্জ সদর উপজেলার উত্তর শ্যামলী গ্রামের আবদুল জলিলের ছেলে। তিনি আরও জানান, শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশন থেকে মামাতো ভাই ও তিনি আন্তনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। মামাতো ভাই ইয়াসিন রাজমিস্ত্রী ছিলেন। তিনি বাহ্মণবাড়িয়া হাসপাতালে মারা গেছে বলে জানতে পেরেছেন কাউছার।
সিলেটে মাজার জিয়ারত শেষে মা, স্ত্রী, মেয়ে, ভাগ্নে বউসহ পরিবারের ৫ জনকে নিয়ে একই ট্রেনে চাঁদপুরের হাইমচরের ঈশানবালা গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন জাহাঙ্গীর আলম (৪৫)। তিনি জানান, মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, কারও পা নেই, কারও মাথা থেকে মগজ বেরিয়ে গেছে। স্থানীয়রা টেনে আমাকে বের করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন, পরিবারের বাকি ৪ সদস্য কোথায় আছে, বেঁচে আছে কি-না তাও জানেন না। কুমিল্লা পুলিশ সুপার আহতদের দেখতে হাসপাতালে আসলে তিনি পরিবারের ৪ সদস্য বেঁচে আছে কি-না, কিংবা কোথায় আছে তা খুঁজে বের করার অনুরোধ করেন।
কুমিল্লা জজকোর্টে একটি মামলার হাজিরা দিতে আসছিলেন মৌলভী বাজারের আবদুস ছোবহান, শ্যালক সফিক ও ভাই আবদুস ছালাম। দুটি ট্রেনের সংঘর্ষের সময় অন্য যাত্রীদের সহায়তায় তিনি ও তার সঙ্গে আরও ২ জন বেরিয়ে আসেন।
তিনি জানান, সংঘর্ষের কারণে পাশের একটি বগি উপরে উঠে যাওয়ায় অনেকের কান্নার শব্দ শুনতে পান, ভোর রাত হওয়ায় তখন স্টেশনে তেমন লোকজন ছিল না, সময় মতো উদ্ধার না হওয়ায় অনেকেই মারা যান।
এদিকে দুর্ঘটনার পর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (কুমেক) ওই তিনজন ছাড়া আরও ১০ জনকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এরা হচ্ছেন- সুনামগঞ্জের রেজাউল করিম, চাঁদপুরের হাসান, রোজিনা আক্তার, জুবায়ের, রোজিনা বেগম, হবিগঞ্জের মুক্তা, সুমন, নাছিমা, ফিরোজা ও শ্রীমঙ্গলের সেনেল।
কুমেক হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সফিউল জানান, ১৩ জনকে আহত অবস্থায় এ হাসপাতালে আনা হয়। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদের মধ্যে ১০ জনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এছাড়া চাঁদপুরের ফারহানা আক্তার (১০) নামে এক শিশুকে জরুরি বিভাগে আনার পর মৃত ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে দুপুরে আহতদের দেখতে এসে কুমিল্লা পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, বর্তমানে এ হাসপাতালে যে তিনজন ভর্তি রয়েছেন তাদের চিকিৎসার খরচ জেলা পুলিশ বহন করছে। দুপুর সোয়া ১টার দিকে একই হাসপাতালে আহতদের দেখতে আসেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান ও জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর। ভয়াবহ এ ট্রেন দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মো. কামাল উদ্দিন/এমএমজেড/পিআর