শিশু তুহিন হত্যা, বাবার পক্ষে কোনো আইনজীবী লড়বেন না

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি সুনামগঞ্জ
প্রকাশিত: ০৬:১১ পিএম, ১৬ অক্টোবর ২০১৯

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় পাঁচ বছরের শিশু তুহিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পরিবারের লোকজন জড়িত জেনে হতভম্ব সবাই। বিষয়টি নিয়ে চলছে সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা।

প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে কোনো বাবা তার আদরের সন্তানকে এমন নৃশংসভাবে খুন করতে পারেন বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না স্থানীয়রা। সেই সঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না সুশীল সমাজ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষার্থীরা।

স্থানীয়দের দাবি, এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সুনামগঞ্জে প্রথম। বাবার কোলে ঘুমন্ত সন্তানকে গলা কেটে হত্যার বিষয়টি জানার পর থেকে পৃথিবীর কার কাছে শিশুরা নিরাপদ সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ।

এদিকে, শিশু তুহিনকে বাবা ও চাচা মিলেই খুন করেছেন এবং আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী আদালতে লড়বেন না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আইনজীবীরা।

সুনামগঞ্জের আইনজীবী, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিশু তুহিনের মতো নৃশংস হত্যার শিকার আর কেউ হয়নি। শিশু তুহিনকে যারা হত্যা করেছেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।

সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মিতা তালুকদার বলেন, পাঁচ বছরের শিশুকে তার বাবা কিভাবে হত্যা করতে পারলেন তা ভেবেই পাচ্ছি না। সন্তানের জন্য বাবা ছাতার মতো। সবসময় সন্তানকে বুকে বুকে আগলে রাখেন বাবা। সন্তানের কোনো ক্ষতি হোক তা কোনো বাবাই চান না। অথচ বাবার কোলেই শিশু তুহিনকে জবাই করা হয়। বিষয়টি সবার জন্য মর্মান্তিক ও হতাশাজনক। এমন বাবার ফাঁসি হোক।

সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। শিশু তুহিন হত্যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে আজ বাবার কোলেও শিশুরা নিরাপদ নয়। আজকে আমার সন্তান এসে যদি প্রশ্ন করে বাবা আমি তোমার কোলে কতটা নিরাপদ তার উত্তর আমার জানা নেই।

রঙ্গালয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, তুহিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শুধু সুনামগঞ্জের নয়, সারাদেশের মানুষের মনে আঘাত লেগেছে। ইতিহাসে এমন হত্যাকাণ্ডের নজির নেই। বাবা ও চাচা কিভাবে পাঁচ বছরের শিশুকে গলা কেটে হত্যার পর পেটে ছুরি ঢুকিয়ে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখতে পারেন, ভাবতেই আঁতকে ও শিউরে উঠেছেন সবাই। খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি; শিশুটির কান ও লিঙ্গ কেটে দেয় তারা। এমন ভয়ঙ্কর হত্যার শাস্তি দৃষ্টান্তমূলক হওয়া জরুরি।

sunamgonj-(1)

জেলা খেলাঘরের সভাপতি বিজন সেন রায় বলেন, তুহিন হত্যার ঘটনায় প্রমাণিত হলো পরিবারেও এখন শিশুদের নিরাপত্তা নেই। এমন ধরনের ঘটনা অতীতে হয়নি, আমরা শুনিনি এবং দেখিনি। তুহিন হত্যায় বাবা ও চাচাদের এমন শাস্তি হোক যে শাস্তি সমাজে দৃষ্টান্ত তৈরি করে, খুনিদের বুক কেঁপে ওঠে।

সুনামগঞ্জের আইনজীবী স্বপন কুমার দাস বলেন, শিশু তুহিন হত্যাকাণ্ড খুবই মর্মান্তিক এবং ভয়ঙ্কর। বাবার কোলে সন্তানকে জবাই করে হত্যার এমন নৃশংস ঘটনা কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের পক্ষে দিরাইয়ের কোনো আইনজীবী দাঁড়াবে না।

জেলা আইজীবী সমিতির সভাপতি মো. চাঁন মিয়া বলেন, ঘুমন্ত শিশু তুহিনকে কোলে করে নিয়ে যায় তার বাবা, খুন করে চাচা। এমন ঘটনা বাংলাদেশের প্রথম নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এই ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই আমরা। এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য আমাদের সমাজকে পরিবর্তন করতে হবে। সমাজে যেসব সংঘাত, হিংসা এবং প্রতিপক্ষের প্রতি প্রতিহিংসা চলছে এসব থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। 

সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, শিশু তুহিন হত্যায় যারা জড়িত আমরা তাদের আইনের আওতায় এনেছি। আমরা চেষ্টা করব দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করার। এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য আমাদের যা যা করা প্রয়োজন তাই করব।

এর আগে রোববার রাতে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় শিশু তুহিনকে হত্যা করে গাছের সঙ্গে মরদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়। সোমবার ভোরে গাছের সঙ্গে ঝুলানো অবস্থায় শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় তুহিনের পেটে দুটি ধারালো ছুরি বিদ্ধ ছিল। তার পুরো শরীর রক্তাক্ত, কান ও লিঙ্গ কর্তন অবস্থায় ছিল। তুহিন ওই গ্রামের আব্দুল বাছিরের ছেলে।

সোমবার রাতে এ ঘটনায় তুহিনের মা মনিরা বেগম অজ্ঞাত ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে দিরাই থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

মঙ্গলবার বিকেলে তুহিনের বাবা আব্দুল বাছির, চাচা আব্দুর মুছাব্বির এবং প্রতিবেশী জমশেদ আলীকে তিনদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। একই সময় হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তুহিনের আরেক চাচা নাছির উদ্দিন ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ার।

জবানবন্দিতে তারা জানিয়েছেন ঘটনার দিন শিশু তুহিনকে ঘুমন্ত অবস্থায় তার বাবা আব্দুল বাছির ঘর থেকে বের করে বাইরে নিয়ে যান। এরপর ঘুমন্ত তুহিনকে গলা কেটে হত্যা করেন চাচা ও চাচাতো ভাই। পরে তুহিনের পেটে দুটি ছুরি বিদ্ধ করে গাছে ঝুলিয়ে দেন তারা। তুহিনকে হত্যায় বাবার সঙ্গে অংশ নেন চাচা নাছির উদ্দিন ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ার।

মোসাইদ রাহাত/এএম/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।