এ কেমন প্রচারণা!
সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টা। সিলেট নগরের অন্যতম ব্যস্ততম সড়ক বাগবাড়ি এলাকা দিয়ে প্রায় এক ফুট লম্বা শিংওয়ালা একটি সাদা রঙের বড় গরু নিয়ে যাচ্ছেন তিন ব্যক্তি। পশুটির গায়ে লাল রঙের একটি ব্যানার জড়ানো। তাতে লেখা রয়েছে ‘পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্টে এই গরুটি জবাই হবে’। গরমের মধ্যে গরুটিকে দ্রুত গতিতে হাটানোয় দুই চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছিল। আর বিশাল আকৃতির এই গরুটি দেখে নগরবাসী রাস্তা থেকে সরছিলেন। উৎসুক ও ভীতসন্ত্রস্ত লোকজনের এমন ছোটাছুটি দেখে একটু এগুতেই জানা গেল গরুটি জবাই করার জন্য এমন নিষ্ঠুরভাবে নগরে হাঁটানো হচ্ছে। সিলেটের জনপ্রিয় পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্টের পশুটি জবাই নিয়ে এই যুক্তিহীন আচরণ অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণের বাংলাদেশে দুটি আইন আছে। একটি হলো ২০১২ সালের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন। আইনটি প্রথম গৃহীত হয় ১৯৭৩ সালে; ২০১২ সালে সর্বশেষ সংশোধিত আইনটিতে বন্য প্রাণী হত্যার দায়ে এক বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে। অন্য আইনটি ১৯২০ সালের পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা নিরোধ আইন। পরবর্তীতে চলতি বছরের জুলাই মাসে প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ, সদয় আচরণ ও দায়িত্বশীল প্রতিপালনের মাধ্যমে প্রাণিকল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় বিধান রেখে জাতীয় সংসদে প্রাণিকল্যাণ বিল, ২০১৯ পাস হয়েছে। এই বিল পাসের মধ্য দিয়ে দ্য ক্রুয়েলটি টু এনিম্যাল অ্যাক্ট, ১৯২০ বাদ দেয়া হয়েছে।
দুটো আইনেই কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান আছে। তাছাড়াও প্রাণীর প্রতি কল্যাণকর ও মানবিক আচরণ করা এবং নিষ্ঠুর আচরণ করা থেকে বিরত থাকতে সুনির্দিষ্ট বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত পরিশ্রম, অপ্রয়োজনীয় প্রহার, ক্ষতিকর ওষুধ প্রয়োগ, অনুমতি না নিয়ে বিনোদন কর্মকাণ্ডে বা ক্রীড়ায় ব্যবহার থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু দুটি আইনই ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।
গরুটির সঙ্গে থাকা পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্টের কর্মচারী ইসলাম আলী জানান, গরুটি নিয়ে আমরা সিলেট নগরীর বিভিন্ন স্থানে হেঁটে হেঁটে জবাই করার কথা বলে আসছি। জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, আম্বারখানা, মদিনা মার্কেট, বাগবাড়ি মেডিকেল রোডসহ বিভিন্ন সড়কে হেঁটে হেঁটে প্রচারণা চালিয়ে আসছি। পশুটি সঙ্গে থাকায় মানুষের নজরও আমাদের দিকে ছিল।
তিনি বলেন, এভাবে প্রায়ই আমরা বড় গরু জবাই করার আগে সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে দেখিয়ে আসি। আর তাতে ভালো সাড়াও মিলে।
সেভ দ্য হেরিটেজ’র সভাপতি আব্দুল হাই আল হাদি জানান, পশুটি জবাই করা আইনত কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু জবাই করার আগের এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত খারাপ। এটা কোনো মানবতার মধ্যে পড়ে না।
তিনি বলেন, এ রকম একটি জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টের এ ধরণের প্রতিযোগিতা কোনোভাবেই উচিত না। শুধু এই রেস্টুরেন্ট না অন্যান্য সময়ও আমরা পশু জবাই নিয়ে প্রচার-প্রচারণা করতে দেখেছি। যারা এসব কর্মকাণ্ড করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রাণিকল্যাণ আইনে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
ভূমিসন্তান বাংলাদেশ সিলেটের সমন্বয়ক আশরাফুল কবীর বলেন, খাদ্যের জন্য আমরা প্রাণী হত্যা করছি। কিন্তু এজন্য পশুর প্রতি নির্মমতা উচিত না। প্রত্যেক প্রাণীর জীবন ধারণের অধিকার আছে। কিন্তু অতি মুনাফা ও বাণিজ্যের জন্য তাদের প্রতি অবিচার করছি। পশুর এমন প্রতি নির্যাতন কোনো ভাবেই কাম্য না। এতে আইনেরও ব্যত্যয় ঘটে।
প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন প্রাধিকারের সাবেক সভাপতি মঞ্জুর কাদের চৌধুরী বলেন, যাদের মনুষ্যত্ব নেই তাদের জন্যই আইন। যাদের বিবেক আছে তাদের জন্য আইনের প্রয়োজন হয় না।
তিনি বলেন, যারা পশুর প্রতি এমন অবিচার করে তাদের প্রচলিত আইনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মঞ্জুর কাদের চৌধুরী বলেন, খাদ্যের জন্য আমরা যে পশু জবাই করি তাতে অনেক নিদের্শনা আছে। অমানবিকভাবে কোনো পশু জবাই করলে সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আমরা এসব মানি না। পশুর প্রতি মানবিক হতে হলে আগে মানুষের মধ্যে মানবতা জন্মাতে হবে। শুধু আইন করলেই এটি বাস্তবায়ন হবে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ বলেন, এটা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তারা যে পশুটি জবাই করছে এটাও বৈধ না। একটি পশু জবাইয়ের আগে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে চেকআপ শেষে নির্ধারিত স্থানে জবাই করার কথা। কিন্তু তারা এসব মানছে না। আমরা কি খাচ্ছি তাও আমরা জানি না। এসব অপরাধগুলো নিরসন করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে কাজ করতে হবে। তা না হলে এসব নিমর্মতা বন্ধ হবে না।
সিলেট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আতিয়ার রহমান জানান, কোনো পশুকেই অযাচিত কষ্ট দেয়া যাবে না। এছাড়া প্রহার ও ক্ষতিকর ওষুধ প্রয়োগসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিরত থাকতে আইন রয়েছে। এসব আইনে দণ্ডের বিধানও রয়েছে। যারা এ ধরণের অমানবিক কাজ করেছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
ছামির মাহমুদ/আরএআর/জেআইএম