হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী চাকা
`আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে... যাবো তোমায় শ্বশুর বাড়ি নিয়ে` কত না জনপ্রিয় গান সৃষ্টি হয়েছে গরুর গাড়ি নিয়ে। গ্রামের কাঁচা রাস্তায় লাল শাড়িতে ঘেরা গরুর গাড়ি অথবা ঘোড়ার গাড়িই ছিল এককালের যাতায়াতের একমাত্র বাহন। কালের বিবর্তনে গরু, মহিষচালিত বাংলার ঐতিহ্যবাহী গাড়িগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু তার অস্তিত্ব যে একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি তার প্রমাণ মেলে ঝিনাইদহের বিভিন্ন এলাকায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার আমতলী বাজার, হাটকোলা মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে, শৈলকুপার ভাটই বাজার, গাড়াগঞ্জ বাজার, খুলুমবাড়ি, কুমিড়াদহ ও আবাইপুর বাজারে গড়ে উঠেছে একাধিক চাকা তৈরির কারখানা। তবে দেশের বৃহত্তর চাকা উৎপাদনকারী এলাকা হিসাবে পরিচিত গাড়াগঞ্জ বাজার এলাকা। বিভিন্ন এলাকার কৃষক ও গৃহস্থরা গরুর গাড়ির চাকার জন্য ছুটে আসেন এসব অঞ্চলে।
সরেজমিনে গাড়াগঞ্জ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রধান সড়কের দু’ধারে অল্প সামান্য জায়গা উপর গড়ে উঠেছে ৮টি চাকা তৈরির কারখানা। কারিগরসহ প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি কর্মরত রয়েছেন এখানে। বংশানুক্রমে ব্রিটিশ আমল থেকেই এ পেশাটিকে আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন তারা। চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এসকল কারিগররা এক পর্যায়ে শৈলকুপার গাড়াগঞ্জ এলাকাসহ ঝিনাইদহের বিভিন্ন এলাকায় এসে কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে চাকা উৎপাদনের বৃহত্তর এলাকা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে ঝিনাইদহ।
গাড়াগঞ্জ বাজারের চাকা তৈরির কারিগর আনছার আলী (৭০) জাগো নিউজকে জানান, তার বাপ দাদারাও চাকা তৈরির পেশায় ছিলেন। বাবার কাছ থেকেই তার এ পেশার হাতে খড়ি। বাবার সঙ্গে বাড়িতেই চাকা তৈরির কাজ করতেন। কিন্তু সেখানে এর চাহিদা কম থাকায় কাজের খোঁজে প্রায় ২০ বছর আগে গাড়াগঞ্জ এলাকায় আসেন তিনি।
তিনি আরো জানান, একটি চাকা তৈরি করতে ১হাজার টাক থেকে সাড়ে ১২শ টাকার কাঠ লাগে। আর শ্রমিকের মজুরি লাগে ৩শ টাকা। বিক্রি করা হয় ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পযন্ত। কোনো যান্ত্রিক যন্ত্রপাতি নয়, শুধু হাতুড়, বাটাল, করাতের মাধ্যমে তৈরি করা হয় দৃষ্টিনন্দন এই চাকা। একজন কারিগর একদিনে একটি চাকা তৈরি করতে পারে।
চাকার মহাজন গোলাম রব্বানী জাগো নিউজকে জানান, মাগুরা, আরপাড়া, বারইচরা, পাবনা, পাংশা, রাজবাড়ি, কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা, যশোর, নড়াইলসহ ঢাকার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারী ব্যাবসায়ীরা ঝিনাইদহের বিভিন্ন চাকা উৎপাদনকারী কারখানা থেকে ট্রাক ভর্তি করে চাকা নিয়ে যান। এভাবেই প্রতিদিন উৎসব মুখর পরিবেশে চাকা ক্রয় বিক্রয় হয় দেশের প্রধান চাকা উৎপাদনকারী এলাকাটিতে।
তিনি আরো জানান, অগ্রহায়ণ, চৈত্র ও ভাদ্র এই ৩ মাস চাকা বিক্রির মৌসুম। ৫-৭ বছর আগে বছরে ১৬শ জোড়া চাকা বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ১শ জোড়ায় নেমে এসেছে।
চাকা তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারিগর ও মহাজনরা জানান, চাকা তৈরির বাবলা গাছ এক সময়ে ছিল সহজলভ্য কিন্তু এখন বাবলা গাছ পাওয়া দুষ্কর। স্থানীয়ভাবে এ কাঠ আর মিলছে না। বর্তমানে পটুয়াখালি থেকে কাঠ এনে কাজ করা হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।
তারা আরো জানায়, অনেক সময় পুজির অভাবে বেশি মূল্যে বাকিতে গাছ কিনতে হয়। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতাসহ ব্যাংক ঋণের সুবিধা পেলে কৃষি কাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এ চাকা শিল্প তথা ঐতিহ্যবাহী গরু মহিষের গাড়ি টিকে থাকবে। সেই সঙ্গে ভাগ্যের চাকাও ঘুরবে এ শিল্পের কারিগরদের।
এসএস/এমএস