স্ত্রীকে মেডিকেলে নেয়ার ভয়াবহ বর্ণনা দিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি কুমিল্লা
প্রকাশিত: ১১:৩০ এএম, ১৭ আগস্ট ২০১৯

কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক তালুকদার। পরিচয় না দিয়ে গভীর রাতে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (কুমেক) স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন তিনি। এ নিয়ে ভুক্তভোগী ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শুক্রবার সকালে ও বিকেলে তার ফেসবুক আইডিতে দুটি স্ট্যাটাস দেন, যেখানে বিড়ম্বনার নানা তথ্য তুলে ধরেন তিনি। এরপর থেকে এ নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় চলছে।

একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার স্ত্রীর চিকিৎসা সেবা নিতে এসে এমন বিড়ম্বনার শিকার হলে সাধারণ রোগীদের অবস্থা কী? এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।

কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের প্রথম শ্রেণির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক তালুকদার শুক্রবার সকাল ৬টা ৫৮ মিনিটে তার ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, ‘রাত ৩:৩০। আমার স্ত্রীর হঠাৎ তীব্র পেট ব্যথা। ও চিৎকার করছিল। খুব ঘাবড়ে গেলাম। ইমার্জেন্সি অ্যাম্বুলেন্সের অনেকগুলো নম্বর নিয়ে কল করতে থাকলাম। কেউ কল ধরল না। বড় বড় হাসপাতালের নম্বরে কল দিলাম। কেউ ধরল না। একজন দয়া করে অ্যাম্বুলেন্সের কল ধরে জানালেন তার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায়। পাওয়া গেল না। আমার মোটামুটি সব ড্রাইভারকে কল দিলাম। ধরল না। অসহায় অবস্থায় বাচ্চাকে ঘুম থেকে তুলে আমার স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটা দিলাম ফাঁকা রাস্তায়। কিছুদূর গিয়ে একটা সিএনজি পেলাম। উনি যেতে রাজি হলেন। গেলাম কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ইমার্জেন্সি তখন ঘুমচ্ছে।

অনেক কষ্ট করে ডিউটি ডাক্তার সাহেবের ঘুম ভাঙানো হলো। উনি কাগজে লিখে দিয়ে ৪তলায় ৪১৭ নম্বর ওয়ার্ডে যেতে বললেন। গেলাম। ওখানে ১৫ মিনিট কাউকে পেলাম না। অবশেষে এক সিস্টার বা আয়া এমন কেউ এলেন। জানলাম ডাক্তার সাহেব ঘুমচ্ছেন। পাক্কা আধা ঘণ্টা ধরে দরজা নক করার পর উনি এলেন। দেখলেন। তারপর ব্যবস্থাপত্র লিখতে গিয়ে দুটো কলমই কালিশূন্য পেলেন। আবার গেলেন তার কক্ষে। গিয়ে ফিরলেন আরও ১০-১২ মিনিট পর।

এদিকে বেশ কয়েকজন রোগী জমে গেছে। অবশেষে আমার স্ত্রীর ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ লিখলেন- এলজিন ইঞ্জেকশন, নরমাল স্যালাইন আর খাবার স্যালাইন। মজার বিষয় হলো ডাক্তার সাহেব সঙ্গে অতিরিক্ত দুটো স্লিপ ধরিয়ে দিলেন।

স্লিপ-১ : ৭টি টেস্টের নাম
স্লিপ-২ : বাদুরতলার শেফা ও আজাদ ক্লিনিকের নাম।

মুখে বলে দিলেন এই টেস্টগুলো যেন ওখান থেকেই করাই। অনেকটা আদেশের মতো। আমি ভেজা বিড়ালের মতো বললাম, জি আচ্ছা। এর মাঝে কথা হলো দেবিদ্বার থেকে আসা এক ডেঙ্গু রোগীর স্বজনের সঙ্গে। তার মহিলা রোগীর প্লাটিলেট কমেই চলেছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু মজার বিষয় হলো রোগীর ওয়ার্ডে কোনো ডাক্তার নেই। ডাক্তার আসবেন সকালে অথবা আরও পরে। পরে আমার স্ত্রীকে নিয়ে চলে এলাম। ইঞ্জেকশনটা একটা বেসরকারি ক্লিনিকে গিয়ে পুশ করালাম।

উপলব্ধি-০১ : গরিবের জন্য কোনো চিকিৎসা নেই

উপলব্ধি-০২ : ডেঙ্গু নিয়ে প্রান্তিক লেভেলে সরকারের নির্দেশনা কতটা ফলো করা হচ্ছে তা ভেবে দেখার আছে।

উপলব্ধি-০৩ : আমাদের স্বাস্থ্য সেবা ২৪ ঘণ্টার নয় বরং ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের (সরকারি/ বেসরকারি) দায়িত্বশীলদের মর্জি মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে।

উপলব্ধি-০৪ : অধিকাংশ বেসরকারি ক্লিনিক কেবল সকাল সন্ধ্যা দোকান খোলে। ব্যবসা শেষে দোকান বন্ধ। রোগী জাহান্নামে যাক। যা আইনত দণ্ডনীয়। ক্লিনিকে অবশ্যই ইমার্জেন্সি ডাক্তার থাকা বাধ্যতামূলক।

উপলব্ধি-০৫ : যত দায় আমাদের।
# রমজানে ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধ করো সকাল-সন্ধ্যা
# রাত জেগে পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা করো
# ঘুম হারাম করে দুর্যোগ মোকাবিলা করো
# ইলেকশনে টানা রাত জেগে কাজ করো
# ঈদে নির্বিঘ্নে জনসাধারণের বাড়ি যাওয়া নিশ্চিত করো
# জাতীয় দিবসের প্রস্তুতিতে অঘুম রাত কাটাও
# বিশেষ সংকটে জেগে থাকো রাতের পর রাত আর খেটে যাও সংকট মোকাবিলায়।
মেডিকেল সেক্টরের জন্য করুণা। স্রোষ্টা হেদায়েত দান করুণ। আমিন।’

এদিকে বিকেলে আরও একটি স্ট্যাটাস দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক তালুকদার। এতে তিনি লেখেন ‘বিনা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় একজন এফসিপিএস ডাক্তারের মাধ্যমে স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র করে নিয়েছেন।’ রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা লেখেন সেখানে।

সন্ধ্যার মধ্যে দুটি স্ট্যাটাস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। এ নিয়ে শুক্রবার দিনব্যাপী শুরু হয় তোলপাড়। চিকিৎসা সেবা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে ফেসবুকে মন্তব্যের ঝড় বয়ে যায়। তবে শুক্রবার রাতে দুটি স্ট্যাটাস ফেসবুক থেকে প্রত্যাহার করে নেন ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক তালুকদার জানান, ‘এটা কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নয়, আমি আমার স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ভোগান্তির শিকার হয়েছি আমার উপলব্দি থেকে কেবলমাত্র তা তুলে ধরেছি।’

তবে কুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. স্বপন কুমার অধিকারী বলেন, সাংবাদিকের মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রীর চিকিৎসা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসের বিষয়টি শুনেছি। শনিবার এ বিষয়ে খতিয়ে দেখা হবে।

তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু রোগীরা ডাক্তারের দেখা পাচ্ছে না এমন অভিযোগ সঠিক নয়। তারপরও এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কামাল উদ্দিন/এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।